প্রতিবছর ঈদ উৎসবের ছুটিতে ঢাকা ছাড়েন রাজধানীতে বসবাসকারী লাখো পেশাজীবি মানুষ। পরিবার পরিজন নিয়ে নিজেদের গ্রামে ও মফস্বল শহরে ছোটেন তাঁরা। নাড়ির টানে বাড়ির পানে ছুটতে গিয়ে প্রতিবছরই ঈদযাত্রায় নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়তে হয় আনন্দপ্রত্যাশী মানুষদের। এবার সেই চিত্র একেবারেই অনুপস্থিত! বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখো মানুষের ঈদ যাত্রায় স্বস্তি এনে দিয়েছে গত বছর জুনে উদ্বোধন হওয়া দেশের সবচেয়ে কাঙ্খিত পদ্মা সেতু।
গত দুই দিনের ঈদযাত্রায় এ পর্যন্ত তেমন কোনো ভোগান্তির খবর চোখে পড়েনি। রাজধানী ঢাকার রেলওয়ে, বাস স্টেশন ও লঞ্চঘাটে আগের বছরগুলোর মতো ততোটা চাপ নেই। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি যেমন প্রাইভেট কার, মোটরবাইক এবং মাইক্রোবাস নিয়েও মানুষ রাজধানী ছাড়ছেন।
ঝিমিয়ে পড়া সদরঘাটও জেগে উঠেছে নৌযাত্রীদের চিরাচরিত পুরনো কোলাহলে। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ
ঈদের ছুটি শুরুর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে মোটরসাইকেল যাত্রার পথ মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে বাইকাররা যারপর নাই উচ্ছ্বসিত। ঈদযাত্রায় এটি তাদের জন্য এক বাড়তি আনন্দ যোগ করেছে। এই সিদ্ধান্তকে উচ্ছ্বাসের সাথে স্বাগত জানিয়েছেন পদ্মার ওপারের ১৯ জেলার শতসহস্র বাইক রাইডার।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শুধু একটি পদ্মা সেতুই ঈদযাত্রায় এযাবৎকালের সব হয়রানি আর ভোগান্তি দূর করে নতুন দিনের সূচনা করেছে। পদ্মা ছাড়াও বেশ ক'টি আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ সড়কেও ফেরী পারাপারের স্হানে সেতু নির্মাণ করায় আগামী দিনগুলোতে যাতায়াত ও পরিবহন আরও স্বস্তিদায়ক হবে।
প্রমত্তা পদ্মায় নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের বহুল আলোচিত মাল্টিপারপাস সেতুটি গত ২০২২ সালের জুনে সীমিত আকারে চালু করা হয়।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, পদ্মা সেতু দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হায় একটি বৃহৎ অবকাঠামো হিসেবে এবার ঈদযাত্রায় এর অবদান সবচেয়ে বেশি। তবে জাতীয় সড়কগুলোতে ফোর লেন ও বঙ্গবন্ধু সেতুসহ আঞ্চলিক সেতুগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া সরকারের ঘোষিত একদিনের কৌশলগত ছুটি'র ঘোষনায় ঢাকায় বসবাসকারী লোকজন ঈদে বাড়ি ফেরার ছকটা ঠিকমতো কষতে পেরেছেন। সব মিলিয়েই এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক বলে মনে হচ্ছে। তবে অবশ্যই পদ্মা সেতুর কন্ট্রিবিউশন এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, অবশ্যই পদ্মা সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্হায় একটা নিউ ইক্যুলিব্রিয়াম (ভারসাম্য) নিয়ে আসছে। এক নতুন ডাইনামিজম সৃষ্টি করেছে।
অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেন, মানুষ তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা করে যাতায়াত করার সুযোগ পেল এবারই প্রথম। এরকমটা আগে দেখা যায়নি। এবার শিডিউল পরিবহনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অনেকে ব্যাক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে পরিবহন ভাড়া করেও বাড়ি ফিরছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে বাড়ি ফেরার উচ্ছ্বাসে বাইকারদের অপেক্ষা। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ
আশাবাদ রেখে তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে আলটিমেটলি গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ও উন্নত সুযোগ সুবিধা দিয়ে স্মার্ট সার্ভিস দেওয়ার পথে এগুতে হবে। তা না হলে ব্যাক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং সারাদেশে বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামোতে চাপ বাড়বে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর ডাটা প্রকাশ করে জানান, মোবাইল সিম এর গতিবিধি অনুযায়ী গত ১৮ এপ্রিল ২০২৩ ঢাকা থেকে বাইরে গেছে ১২ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮ ব্যাক্তি। এর বাইরে মোবাইল ব্যবহার করেন না এমন ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যরাও আছেন।
আরও জানানো হয়, ওই তারিখে ঢাকায় এসেছে ৬ লাখ ৬৭হাজার ৭৮৩ সিমধারী।
বিটিআরসি'র তথ্য অনুযায়ী, এর পরদিন ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে বাইরে যায় ১৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৪৫ সিমধারী ব্যক্তি। এ দিন ঢাকায় ঢোকে ৬ লাখ ৩২ হাজার ৫২২ সিমধারী।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতে আগের বছরগুলোর মতো চাপ নেই দূরপাল্লার বাসগুলোতেও।
ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে নাগরিক কোলাহলময় ঢাকা। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ
ঢাকা থেকে নরসিংদী হয়ে সিলেট বিভাগ ও কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলাগামী বাসগুলোতেও ছিলো একই চিত্র। তবে গার্মেন্টস কারখানা ধাপে ধাপে ছুটি হওয়ায় রাতের বাসগুলোতে যাত্রী ভর্তি দেখা গেছে। সড়কে প্রচুর বাসও ছিলো। যাত্রী হয়রানি ও বাড়তি ভাড়া আদায়ের আগের বছরের তুলনায় এবার অনেক কম।
স্বল্প ভাড়ায় নিন্ম আয়ের লোকজন ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগে ও উত্তরবঙ্গে নিজ নিজ জেলায় যেতে লঞ্চ ও ট্রেন এর প্রতি বেশী নির্ভরশীল ছিলো বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবার ঈদে রাজধানীর লোকজনকে বাড়ি পৌঁছে দিতে ২৬টি ট্রেন পরিচালনা করছে। এসব ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে ও সঠিক সময়ে ট্রেনে উঠতে যাত্রীদের শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়টি কড়া নজরদারি করেছে। অনলাইন টিকিটে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ এ ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখছে।
বৃহস্পতিবার পোশাক কারখানাগুলোতে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। এদিন রাতের বাসে চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে শিল্প পুলিশ ও পরিবহন শ্রমিক সুত্রগুলো জানিয়েছে।