ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট: কলেজের মাঠে নেই খেলাধুলা, চলছে ভাড়া-বাণিজ্য

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২৯, ২০২২, ০১:৪৫ এএম

ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট: কলেজের মাঠে নেই খেলাধুলা, চলছে ভাড়া-বাণিজ্য

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার একমাত্র মাঠ ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের মাঠ। এই মাঠ কলোনী বাজার মাঠ বা লাল মাঠ নামেই বেশি পরিচিত। এই মাঠে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর খেলাধুলা করবার কথা। কিন্তু সেখানে নেই খেলাধুলার বালাই। উল্টো মাঠের নানা অংশ দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ভাড়াবাণিজ্য। মাঠটিকে বাজারও বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

মাঠে চায়ের দোকান, রিকসার গ্যারেজ, হোটেল, ভাঙ্গারির দোকান থেকে শুরু করে সবকিছুই আছে। বেদখলের বাইরে যেটুকু রয়েছে তা দেখে সেটিকে মাঠ বলে মনে হবে না।

মাঠের ভেতরেই চলছে চায়ের দোকান, রিকসার গ্যারেজ ও বানানো হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। এসব থেকে তোলা হচ্ছে ভাড়া। প্রতি মাসে ১০ লক্ষ টাকা ভাড়া উঠানো হয় এখান থেকে। গত পাঁচ বছরে এই মাঠের দোকান-গ্যারেজ থেকে তোলা হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকারও ওপরে।

স্থানীয়রা জানান, ওই এলাকার প্রথম শ্রেনীর ঠিকাদার নূর হোসেন লেদূ তাঁর ভাই-সহযোগীদের দিয়ে ওই ভাড়া তোলার কাজ করেন। শুধু লেদূ নয় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাও নেয় ওই টাকার ভাগ।

Dhaka Mathh-05 1

২০১৩ সালে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের কাজের জন্য একটি কোম্পানি মাঠটি ভাড়া নেয়। এ জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে প্রতি মাসে মাঠের ভাড়া ও সংস্কারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প শেষে মাঠটি খালি করে দেয় ওই কোম্পানিটি। তারপরই গড়ে উঠে এই সকল অবৈধ স্থাপনা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাঠজুড়ে রয়েছে সকল অবৈধ স্থাপনা। মাঠে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পরে একটি খাবারের হোটেল। যা স্থানীয় কাউন্সিলরের গাড়ি চালক আলমের হোটেল বলে জানা যায়। তার পাশ দিয়েই গড়ে উঠেছে দুইটি চায়ের দোকান। এর পাশেই রয়েছে একটি ভাঙ্গারির দোকান। ভাঙ্গারির দোকানের পাশেই আবার দুইটি চায়ের দোকান। চায়ের দোকান পার হলেই কলোনী বাজার জামে মসজিদ। মসজিদটি আগে মাঠের বাইরে থাকলেও বছরখানেক আগে তা বাড়িয়ে মাঠের ভেতরে আনা হয়েছে।

মাঠের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি ক্লাবঘর। ক্লাবঘরটির পাশ ধরেই গড়ে উঠেছে ৩০০টির মতো ঘর। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নূর হোসেন লেদূর বোনজামাই আলাউদ্দিন, মানিক মুন্সি, জামাল ভান্ডারি ও খলিল এ ঘরগুলোর ভাড়া তোলেন। এছাড়াও ঢাকা পলিটেকনিক ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের এর কোয়ার্টারের লোকেরাও ভাড়া তোলে এখানকার ঘরগুলোর। মাঠের চায়ের দোকানদার মিজান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, প্রতি ঘর থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে ভাড়া তোলা হয়।

মাঠের পশ্চিম পাশে রয়েছে পাঁচটি অবৈধ রিকসার গ্যারেজ। যেখানে প্রায় দুইশটির মতো রিকসা রয়েছে। একটি গ্যারেজের মালিক আমিন ব্যাপারি। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, পুলিশকে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে টাকা দিতে হয়। আর লেদূ কাকাকে দিতে হয় মাসে দুই হাজার টাকা।

এ সকল স্থাপনার বাইরেও মাঠটি পার্ক করা গাড়ি দিয়ে ভরা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার গাড়িও রাখা হয় এই মাঠে। শুধু থানার গাড়ি নয় বিভিন্ন কোম্পানির গাড়িও রাখা হয় এই মাঠে। এই গাড়িগুলো থেকেও প্রতি মাসে ভাড়া তোলা হয় ১৫শ টাকা করে। মাঠের পাশে রেজিস্ট্রি অফিসের সিকিউরিটি শামীম এই ভাড়া তোলেন বলে জানা গেছে।

এই এলাকায় শৈশব থেকে বসবাস করে আসছেন যুবক লুৎফর রহমান মিন্টু। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই এ এলাকায় বড় হয়েছি। এ মাঠে অনেক খেলাধুলা করেছি। মাঠটি আগে সবুজ ঘাসে ভরা ছিল। এ এলাকায় তেমন কোনো উন্মুক্ত খেলার মাঠ নেই। পলিটেকনিকের মাঠে শিক্ষার্থীসহ সবাই খেলাধুলা করত। তবে ফ্লাইওভারের কাজের জন্য মাঠটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তারা চলে গেলেও মাঠটি আর দখলমুক্ত করা হয়নি।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানালেন, কলেজের প্রিন্সিপালের সদিচ্ছা না থাকায় মাঠটি আর দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে দখলের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন স্থানীয় ঠিকাদার নূর হোসেন লেদূ। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বললেন, ‘আপনি যদি একটা প্রমাণ আমাকে দেখাতে পারেন, যে শাস্তি দিবেন ওই শাস্তি আমি মাথায় পেতে নিমু। এটি ঐখানকার স্টাফরা ভাড়া দিয়ে খায় আর দোকানপাটও যার যার টা হে হে করে। এসব ব্যাপারে আমার কোন যদি প্রমাণ পান একেবারে উপযুক্ত বিচার হবে আমার। চাঁদাবাজি তো দূরের কথা একফোটা মাটির ঘরও নাই আমার ওর ভিতরে। যার টা হে কইরা খাইতাছে আর পলিটেকনিকের স্টাফরা ভাড়া দিয়া খাইতেছে। ক্লাব, মাটি সব ভাড়া দিয়ে খায় স্টাফরা। তারা এখানে থাকে না তারপরও ভাড়া দিয়া খায়। অবৈধ দোকানপাট আছে। এগুলো আপনি সব উচ্ছেদ করেন। আমি বলমু কার কাছে এই কথা। এসব পয়সা লেদূ খায় না। লেদূ মানুষকে খাওয়ায় আল্লার রস্তে।’

টাকা উত্তোলনের অভিযোগ অস্বীকার করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী আবুল কালাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘এটা পলিটেকনিকের মাঠ। তারাতো কখনো আমাদেরকে এসব বিষয়ে কিছু বলে নাই। আর আমরা তো তাদের থেকে অনুমোদন নিয়েই রাখছি। এটার জায়গাও সরকারি আর আলামতগুলোও সরকারি। এখানে তেমন কোনো খেলাধূলাও হয় না। আর আমরা এক কর্ণারে সামান্য জায়গা নিয়ে আছি। এতে কোন সমস্যা হচ্ছে না বলে মনে হয়।’

আর এই মাঠে সিটি করপোরেশনের কোন দায়ভার নেই বলে জানান ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিউল্লাহ শফি। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘এটি পলিটেকনিকের মাঠ। তারা উচ্ছেদ করবে, না কি করবে না— এটা তাদের ব্যাপার। এখানে সিটি করপোরেশনের কোন দায়ভার নেই।’

মাঠটি দখলমুক্ত কেনো হচ্ছে না, জানতে চাইলে এ বিষয় কিছু জানেন না বলে জানান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার মোজাম্মেল হক। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, এই মাঠটার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে মনে হয় দেয়াল দিছে সম্ভবত। আপনি প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে এ বিষয় সবকিছু জানতে পারবেন।

তবে এ বিষয় কথা বলতে নারাজ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার কাজী জাকির হোসেন। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে শুধু এটুকুই বলেন, ‘আমি এ বিষয় কিছু বলবো না। আমাকে বলতে হলে উপর মহলের অনুমতি নিয়ে বলতে হবে। আর এখানে সব কিছু ঠিক আছে। থানার গাড়ি রাখার জায়গা নাই। তাই তারা এখানে গাড়ি রাখে। এতে পোলাপাইনদের খেলাধূলায়ও সমস্যা হচ্ছে না।’

 

Link copied!