কয়েকজন কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত করে দিলেই বিদেশিদের তৎপরতা কমে যাবে: ওয়ালিউর রহমান

মিজানুর রহমান খান

জুলাই ২৩, ২০২৩, ০২:৩০ এএম

বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশে সম্প্রতি সফর করে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশ সফরে এসে এখনও ঢাকায় অবস্থান করছে। দেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি প্রতিনিধিদের এই তৎপরতা নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে নানা মহলে। নানা মত দিচ্ছেন দেশের কূটনীতিকরাও।

এ প্রসঙ্গ নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ—এর সাথে কথা বলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ দূত ওয়ালিউর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ—এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।

দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরা হঠাৎ করে তৎপরতা চালাচ্ছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? তাদের পেছনে কারা থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ওয়ালিউর রহমান: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিশ্বের অনেক দেশ আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। এই দেশটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিরোধিতা করেছে। শুধু বিরোধিতা নয়, তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েও সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশটির বেশ কয়েকজন কূটনীতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বাংলাদেশের বিরোধীতায় সোচ্চার হয়েছেন। এমনকি তারা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেনে নিতে পারেননি। এদের একজন হলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। বর্তমানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্র ফিরে গেছেন। তিনি কিন্তু একজন যুদ্ধাপরাধী। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসে তিনি যুদ্ধাপরাধ করেছেন। যুদ্ধাপরাধী তালিকায় তার নাম আছে। হেনরি কিসিঞ্জার এখনও বঙ্গবন্ধুকে নিজের অন্যতম প্রধান শত্রু বলে মনে করে থাকেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে সাম্প্রতিক এই বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতার পেছনে হেনরি কিসিঞ্জার এবং তার সমভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই রয়েছেন। তবে আস্তে আস্তে এই তৎপরতা কিন্তু কমে আসছে।

দ্য রিপোর্ট: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর এত আগ্রহ কেন? তাদের এমন তৎপরতা কী ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী নয়?

ওয়ালিউর রহমান: ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা যে তৎপরতা চালাচ্ছেন তা যদি ভালো উদ্দেশ্যে হতো, দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো। এদের মোটেও ভালো আগ্রহ বা উদ্দেশ্য  নেই। তারা যে কাজ করছে তা ভিয়েনা কনভেনশনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী-ডাইরেক্ট ইন্টারফেয়ারেন্স। ইললিগ্যাল ইন্টারফেয়ারেন্স। তাদের লজিক্যাল কোনো গ্রাউন্ড নেই। হিরো আলম বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে ১২টি ইউরোপীয় দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে তা সঠিক হয়নি। অ্যাবসার্ড। আনহার্ট। এটা কোনোভাবে হতে পারে না-অগ্রহণযোগ্য। আমরাও তো রাষ্ট্রদূত ছিলাম। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনো কাজ তো আমরা করিনি। কাজেই তারা যা করছে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে করছে। একটা স্বাধীন ও জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশের বিরুদ্ধে তারা এহেন কাজ করতে পারে না।

দ্য রিপোর্ট: তাহলে এইসব কূটনীতিকদের তৎপরতা রোধে কী বব্যস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ওয়ালিউর রহমান: দেখুন, আমরা একবার ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। সামরিক সরকারের আমলে-জেনারেল এরশাদের সময়ে। ওই সময় ডিজিআইএফ ও এনএসআইয়ের রিপোর্ট মোতাবেক সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চেীধুরী ও পররাষ্ট্র সচিব ফারুক আহমেদ চৌধুরী আমাকে বিষয়টি হ্যান্ডেল করার জন্য দায়িত্ব দিলেন। দায়িত্ব পেয়েই আমি মোট ২৮ জন কূটনীতিককে সাত দিনের নোটিশে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বলেছিলাম। শুধু তাই নয়, ওই সময় অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকেও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তলব করে তাকে দেশ ছাড়ার নোটিশ দিয়েছিলাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনটাই করা উচিত।

দ্য রিপোর্ট: আপনিতো এক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন, রাষ্ট্রদূত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূতের দায়িত্বও সফলভাবে সামলিয়েছেন। তাই বিদেশি কূটনীতিকদের অপতৎরতা বন্ধে সরকারের প্রতি আপনার  কোনো পরামর্শ আছে কিনা?

ওয়ালিউর রহমান: প্রয়োজনবোধে আমি আপনাদের (মিডিয়া) মাধ্যমে সরকারকে অনুরোধ করবো, আহবান জানাবো, যেহেতু বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের আপনারা এতবার বলছেন তারা শুনছেন না। তারা ভিয়েনা কনভেনশনকে সম্পূর্ণভাবে ভায়োলেট করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তাই আপনারা (সরকার) অ্যাম্বেসি থেকে অ্যাম্বাসেডরদের নিচে যারা রয়েছেন তাদের থেকে গুনে গুনে কয়েকজন কূটনীতিককে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ (অবাঞ্ছিত) ঘোষণা করে দেন। অন্যদের সব তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে।

(কূটনীতিতে পার্সোনা নন গ্রাটা বলতে এমন বহির্দেশীয় ব্যক্তিকে বোঝায় যার নির্দিষ্ট কোন একটি রাষ্ট্রে অবস্থান ও প্রবেশ ওই রাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক কথায়- পার্সোনা নন গ্রাটা বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি গ্রাহক রাষ্ট্র কর্তৃক অগ্রহণযোগ্য ও অবাঞ্চিত ঘোষিত হয়েছেন।)

আমি সেই যে ২৮ কূটনীতিককে ‘পার্সোনা নন গ্রাটা করলাম, তারপর থেকে তাদের তৎপরতা আর চোখে পড়লো না। সময় এসেছে। আমাদের অ্যাকশনে যেতে হবে। ডেকে বললে হবে না। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে হবে না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব– তারা সবাই চেষ্টা করছেন। খুব চেষ্টা করছেন তাদের জায়গা থেকে। কোনো ধরনের সুরাহা হয়েছি কী? কিছু কাজ হয়েছে? হয়নি। দে ডোন্ট কেয়ার। আমি বলবো-টাইম হ্যাজ নাউ কাম। অ্যাকশান নিতে হবে। কূটনীতিকদের থেকে দুই- চারজনকে  ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা দেন। দেখবেন সব বন্ধ হয়ে যাবে। কী করবে তারা? হইচই করবে একটু। তাতে কিছু যায় আসবে না। শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই কাজ হবে। আমি নিশ্চিত, কাজ হবেই।

দ্য রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল সফরে এসেছিলেন। এই সফরের পর আওয়ামী লীগ সরকার ও বিএনপি ভিন্নধর্মী মতামত দিচ্ছে। আপনি সফরটিকে কীভাবে দেখছেন?

ওয়ালিউর রহমান: আমি মনে করি এটি সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে উজরা জেয়ার যে বৈঠক হলো তা অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়েছে। বৈঠকে তারা বিএনপির দাবি নিরপেক্ষ সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেনি। বৈঠক শেষে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। শুধু বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে সুষ্টু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস ও গ্রহণ করেছি এবং এই বিশ্বাস নিয়েই দেশে ফিরে যাচ্ছি। এমনকি তারা বিএনপির  প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে চাইলেন না।

দ্য রিপোর্ট:  এই যে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করলেন না। কী কারণে দেখা করলেন না বলে আপনার মনে হয়?

ওয়ালিউর রহমান: আমি মনে করি যেভাবে তারা বলে –আমরা নির্বাচনে যাবো না যদি প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা না ছাড়েন বা তাঁর সরকার পদত্যাগ না করে। আমেরিকানরা এ ধরণের কথা পছন্দ করেন না। আমেরিকা ডোন্ট লাইক দিস। একটা নির্বাচিত সরকার দেশ শাসন করছে, আপনি তাকে গায়ের জোরে বলবেন, আপনি যদি রিজাইন না করেন তাহলে আমরা ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না; এটি পশ্চিমাদের অপছন্দের। উজরা জেয়া একটা অসামান্য কাজ করেছেন। এটা আমাদের দেশের জন্য ভাল হয়েছে। আমি মনে করি এটি একটি পজিটিভ সাইন। পজিটিভ কনট্রিবিউশন। থ্যাঙ্কস টু অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটা সম্ভব হয়েছে।

দ্য রিপোর্ট: ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে ফিরে গিয়ে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল পাঠাবে কিনা সে বিষয়ে রিপোর্ট দেবে। পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল যদি তারা না পাঠায়?

ওয়ালিউর রহমান: শুনুন, খুবই  সহজ এটি। এটাতো প্রথমবার নয়। আগেও তারা এসেছে, আমরাই তো নিয়ে এসেছি। এবারও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা কতজন আসবেন আসেন। সমস্যা নাই। তাই আমি বলবো, আসতে চায় আসুক। যখন তাদের এতই আগ্রহ অলরাইট, কাম এন্ড গো ওভার দ্য কান্ট্রিসাইড। ২০১৪-১৫ সালে তারা এসেছে। এর আগে ২০০৬ সালে এসেছে। আর তারা না আসলেও আমাদের ভয়ের কিছু নেই। অর্থনীতি নিয়ে চিন্তিত নই। আজকে দেখেন আমেরিকার ব্লুমবার্গ হচ্ছে পৃথিবীর একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংস্থা। এরকম একটি সংস্থা বলছে, বাংলাদেশ যেভাবে উন্নতি করছে তাতে ২০৭৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬তম উন্নত দেশে  পরিণত হবে। ব্লুমবার্গ বলছে এটি। তাই আমাদের ভয়ের কিছু নেই।

দ্য রিপোর্ট: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ওয়ালিউর রহমান: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকেও ধন্যবাদ।

Link copied!