প্রতারণার ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যমকে নানাভাবে ব্যবহার করছে প্রতারকচক্র। জনপ্রিয় ফেসবুক, ইউটিউবসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নানা লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করছে। এতে না জেনে না বুঝে লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকেই হচ্ছেন নিঃস্ব। আবার কেউ কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন যে, লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিকার চাইতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যাচ্ছেন না।
এরপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা পড়েছে বিস্তর অভিযোগ। অনেক অপরাধী ধরা পড়লেও কমছে না অপরাধের মাত্রা। গোয়েন্দা পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত গেমিং ও অনলাইন জুয়া সক্রান্ত ৬৪টি অভিযোগ সাইবার সেন্টারে জমা পড়েছে। ক্রেডিট কার্ড সক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে শতাধিক,ই-কর্মাস সক্রান্ত প্রতারণা রয়েছে ৮৬টি, অর্থনৈতিক সাইবার ক্রাইম রয়েছে ৪০টি,আর অনলাইন পারচেজ সক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে ৮৭টি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতায় প্রকাশ্যে জুয়া-হাউজি কমে আসলেও ডিজিটাল পদ্ধতির অপব্যবহার করে অ্যানড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে জমজমাট হয়ে উঠেছে জুয়ার আসর। এটাকে বর্তমানে নাম দেয়া হয়েছে- অনলাইন জুয়ার আসর। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন লীগ খেলা ও মোবাইল গেমকে কেন্দ্র করে বেটিং তথা বাজি ধরা চলে। আয়োজকের ভূমিকায় থাকে একটি ওয়েবসাইট। সাইটগুলো নেট দুনিয়ায় ‘বেটিং সাইট’ নামে পরিচিত।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দেশে-বিদেশি বিভিন্ন নামে বেটিং সাইট রয়েছে। ওই সাইটগুলোতে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনও মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিয়ে থাকে। পরে একটি চক্রের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তা ডলারে রূপান্তরিত করে জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে জমা করে। অনলাইন জুয়াড়িরা বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা আদান-প্রদান করে থাকে।
সম্প্রতি সিআইডি ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এই চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। প্রতারক চক্রের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কয়েক কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে। আর ওইসব অর্থ ক্রেডিট কার্ড ও ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেটিং সাইটের মালিকদের কাছে পাচার করা হয়। এরপর বেটিং সাইট ডলার পাবার পর জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে সেই পরিমাণ প্রদর্শন করে। এভাবেই জুয়াড়িদের হাত ধরে পাচার হচ্ছে টাকা। আবার এজেন্টদের হাত ধরে হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থপাচার হচ্ছে। জামিনে বের হয়ে অপরাধীরা আবারও একই অপরাধে জড়াচ্ছেন।
সিআইডি সূত্রে জানা যায়, ৭০ থেকে ৮০ গুণ লাভের লোভ দেখিয়ে ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত জুয়ার সংখ্যা বিক্রি করা হয়। একজন একাধিক সংখ্যা কিনতে পারেন। দিনে দুবার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে একজন বিজয়ী হয়ে লাভবান হলেও নিঃস্ব হয়ে পথে বসে অন্য জন ।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো.রেজাউল মাসুদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, অনলাইনভিত্তিক লুডু, ক্যারাম, তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ও বিশ্ব জুড়ে পাবজি গেম সবথেকে জনপ্রিয় গেম হয়ে উঠেছে। পাবজি গেইম, ফ্রি-ফায়ারসহ শতাধিক গেমে আসক্ত হচ্ছেন কিশোর-কিশোরীরা। আর এসব খেলায় বেশিরভাগ সাইট পরিচালনা করা হয় দেশের বাইরে থেকে।
সিআইডি পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “চাহিদা বাড়ায় প্রতিদিনই গজিয়ে উঠছে নতুন সাইট। গেমভিত্তিক মোবাইল অ্যাপসও আছে। তাই কিশোর-কিশোরীরাও এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্মে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকে। চক্রের অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। বন্ধ করা হচ্ছে সাইট। যারা এখনও সক্রিয় তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।”
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো.রেজাউল আরও বলেন, “ গত জুলাই মাসে চার হাজার জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন নামে-বেনামে জুয়ার সাইট খুলে বসে। এখনো প্রায় শতাধিক জুয়ার সাইট রয়েছে বলে জানা গেছে।এসব জুয়ার সাইট এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন ৭০/৮০ শতাংশ টাকা তাদের পকেটে চলে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ব্যবহারকারীরা।
গ্রেফতার হওয়া অনলাইন জুয়াড়ী ও তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয় জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মো.রেজাউল আরও বলেন, “অনলাইন জুয়াবিষয়ক একটি আইন করার প্রস্তুতি চলছে। আইন কার্যকর হলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরো ভালোভাবে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান।