ভোজ্যতেলের দামে নাকানি চুবানি খাচ্ছে ভোক্তারা। নানা অজুহাতে দুই বছরে ৮ দফা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সকল ধরনের ভোজ্যতেলের দাম।এসময়ে গ্রাহক পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৮৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। মূলত বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কাছে নিয়ন্ত্রণ থাকা ও দেশে উৎপাদন কম থাকার কারনে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলেন জানায় বাজার বিশ্লেষকরা।
ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে ভোজ্য তেল
২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাজারে প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের মূল্য ছিল ৭৮ টাকা। দুই বছর পরে ভোক্তাকে এই তেল ক্রয় করতে হচ্ছে ১৪৬ টাকায়। এক বছর আগেও এই তেল বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকায়। সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৮৭ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলে দাম বেড়েছে; কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। আমাদের কর্মসংস্থান কমেছে। করোনার প্রভাবে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের বেতন কমে গেছে। সরকার পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে এই উন্নয়ন আমার কী কাজে আসবে।
ভোজ্যতেল পরিশোধনের সক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত
দেশে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে পাঁচটি পরিশোধনকারী কারখানা। এই পাঁচ কারখানার মালিকই নির্ধারণ করেন বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য কত হবে। তারা ঠিক করেন, দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে কত কমবে, আদৌ কমবে কি না। বর্তমানে ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানিতে সবগুলো সক্রিয় নেই। সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোই মূলত ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানা গেছে। দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে বছরে ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে সয়াবিনের চাহিদা ১১ লাখ টন, পাম অয়েলের তিন লাখ টন এবং সরিষার এক লাখ টন।
সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও টিকে গ্রুপ মূলত ৭০ শতাংশ সয়াবিন তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মাঝেমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিম মেঘনা ও সিটি গ্রুপের মিলও পরিদর্শন করলেও কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সাত্তার মন্ডল বলেন, যখন বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব চলে যায় তখন তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বেশ কয়েকবারই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সরকারের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বিকল্প ভোজ্যতেল সরবারহ না করলে দাম নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য।
তিনি আরও বলেন, দেশে ২০০৮ সালে তেলের দাম ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা হয়েছিল। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে এর তিনভাগ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। তাই ব্যবসায়ীরা যে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করছে এমন তথ্য বিভ্রান্তিকর।
দাম কমলে হচ্ছে না সমন্বয়
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমবে, তখন দেশের বাজারেও কমানো হবে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমায়নি। এই বছরের শুরুতে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলে সরকার তাতে সায় না দিয়ে কিছুদিন সময় নেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারের কথা শোনেনি; বরং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মৌন সম্মতিতে খোলা তেলের দাম তাদের সুবিধা অনুযায়ী বাড়িয়ে নিয়েছে।
বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি
গতমঙ্গলবার ২৩ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে তারা বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত রোববার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়। তাতে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম হবে ১৬৮ টাকা। আর বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম হবে ৭৯৫ টাকা। এত দিন ছিল ৭৬০ টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবরে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৫০৫ থেকে ৫১৫ টাকা।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রায় দুই বছর যাবৎ করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সীমাহীন আর্থিক দুরবস্থায় নিমজ্জিত। করোনাকালে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে, আয় কমেছে অনেকের। এ রকম পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নতুন করে ভোজ্যতেল বিশেষত সাধারণ মানুষ যে তেল ব্যবহার করে সেই সয়াবিন ও পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে আরো কষ্টকর করে তুলবে।