পুরান ঢাকা ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হলেও বাসিন্দারা মৃত্যুর সাথেই বসবাস করছে। কিন্তু ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন থাকলেও স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে ১৭ বছর ধরে। কিন্তু এখনও পুরোপুরি স্থায়ীভাবে সমাধান মেলেনি। যার ফলে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে তারা।
চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির ৩ বছর পর চার্জশিট
রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ। প্রায় তিনবছর ৮ জানুয়ারি এ চার্জশিট দাখিল হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এমন ভয়াল পরিস্থিতিই দেখা গিয়েছিল। চকবাজার পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুপুরীতে, কেড়ে নিয়েছিল ৭১টি প্রাণ।
আজ ২০ ফেব্রুয়ারি সেই মর্মান্তিক কাণ্ডের তিন বছর হলো। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও এমনটাই ঘটেছিল। প্রাণের পর প্রাণ ঝরে, পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল সরে না। গণমাধ্যমের সংবাদে ও মানুষের মনে দগদগে ঘায়ের মতো এসব স্মৃতি যত শুকিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বও ততই ফুরিয়ে যায়।
গত ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়, তা থেমে যায় এক পক্ষকালের মধ্যেই। ২০১৯ সালের ৪ মার্চের পর হয়নি এ সংক্রান্ত আর কোনো অভিযান। গত ১১ ডিসেম্বরও কেরানীগঞ্জের প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২২ জন নিহত হন। গত কয়েক বছরে কেমিক্যালের কারণে যত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সব কটিই পুরান ঢাকায়। জানা গেছে, লালবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কদমতলী এই আট থানায় বর্তমানে কেমিক্যালের প্রায় ২৫ হাজার অস্থায়ী দোকান, কারখানা ও গুদাম রয়েছে।
আর্থিক সংকটে কেমিক্যাল পল্লী
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে যে কেমিক্যাল পল্লী গড়ার কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে সেটি এখন এগোচ্ছে না। কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ভূমি অধিগ্রহণে অর্থসংকটে পড়েছে বিসিক। তাই দ্রুত ভিত্তিতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের অতিরিক্ত ৮২০ কোটি টাকা চেয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। গত বছরের ২৯ অক্টোবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
বিসিকের অধীনে বাস্তবায়নাধীন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী এ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১ হাজার ২ কোটি টাকার প্রয়োজন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ জেলা প্রশাসককে ১০৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটির অনুকূলে বরাদ্দ রয়েছে ৮০ কোটি টাকা। জমির মূল্য বাবদ মূলধন খাতে ৮২০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, কোনো একটি প্রকল্পে একবারেই এত টাকা বরাদ্দ দেওয়ার মতো তহবিল নেই। তাই আগামী বছরে বরাদ্দের জন্যও অপেক্ষা করতে হবে।
প্রক্রিয়া চলছে ১৭ বছর
সূত্র জানায়, প্রথম দিকে ২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কেমিক্যাল পল্লী নির্মাণের পরিকল্পনা করে। তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। তারপর বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিসিক। দুর্ঘটনা রোধসহ আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা গোডাউন অপসারণের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি বিসিক কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এজন্য মোট ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই হতে ২০২১ সালের জুনে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুমোদন দেয় একনেক।
সংশোধনের প্রকল্পে ধীরগতি
কিন্তু চকবাজার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার পর কেমিক্যাল পল্লীটি আরও বড় পরিসরে এবং তুলনামূলক কম জনবহুল এলাকায় স্থাপনে গুরুত্বারোপ করা হয়। সে জন্য অনুমোদিত বিসিক কেমিক্যাল পল্লীটি ঢাকার কেরানীগঞ্জে স্থাপনের পরিবর্তে ঢাকা-দোহার সড়ক বরাবর মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার তুলসীখালী ব্রিজ সংলগ্ন গোয়ালিয়া, চিত্রকোট ও কামারকান্দা নামক তিনটি মৌজায় মোট ৩০৮ একর জমিতে স্থাপনের জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, অতি শিগগিরই শ্যামপুরে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানো হবে। এ ছাড়া গাজীপুরেও কেমিক্যাল গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আগামী বছরের মধ্যেই সিরাজদিখানে কেমিক্যাল গুদাম সরানোর কাজ করা হবে।
২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬.১৭ একর জমিতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৪টি অস্থায়ী গুদাম নির্মাণকাজ শুরু হয়। আগামী জুন মাসের মধ্যেই এর কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানান শিল্পমন্ত্রী। তবে এভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে একবার এক স্থানে, পরে স্থায়ী ভিত্তিতে ফের আরেক স্থানে প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। তারা বলছেন একেবারে স্থায়ী একটি সমাধান। গতকাল পুরান ঢাকার মিডফোর্ড, চকবাজার, পোস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে কেমিক্যাল গুদাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা এ তথ্য জানা যায়।
মিডফোর্ডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী রাজু আহমেদ বলেন, সবার স্বার্থে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করব। কিন্তু একবার সিলগালা করে রাখা, একবার শ্যামপুরে স্থানান্তর করা, পরবর্তী সময়ে আবার মুন্সীগঞ্জে যাওয়াÑ এমনটি হলে পুরো কেমিক্যাল খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অস্থায়ী গুদামে বাড়তি খরচ না করে মুন্সীগঞ্জে সবার জন্য কেমিক্যাল গুদাম নির্মাণ করাটাই শ্রেয়তর বলে মনে করেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের কেমিক্যাল ও পারফিউমারিবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা অতিদাহ্য কেমিক্যাল আগে থেকেই সরিয়ে ফেলেছি। এ ছাড়া বারবার স্থানান্তর হলে ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হবে না। বিসিক ১০ বছর ধরেও আমাদের কেমিক্যাল পল্লী দিতে পারেনি। এর দায় তারা এড়াতে পারে না।