অক্টোবর ১৪, ২০২১, ১০:২৪ পিএম
১৭ বছরের কিশোরী সুরাইয়া নেওয়াজ লাবণ্য। বিয়ে হয়েছিল বছর খানেক আগেই। বিয়ের পর সন্তানসম্ভবা হন। লাবণ্যর অনাগত সন্তানের ভ্রূণ যতো মানুষে রূপ নিচ্ছিল তার সঙ্গে তার ওপর তার স্বামী-শাশুড়ি নামক অমানুষের অত্যাচারও বাড়তে থাকে।
সেই নির্যাতন সইতে না পেরে সন্তানের কথা না ভেবেই নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সে। তারপর শরীরের ৯০ ভাগ পোড়া নিয়ে হাসপাতালে জন্ম দিয়েছিল মৃত এক কন্যাসন্তানের। মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে মাও।
রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে মারা যান লাবণ্য। তার মৃত সন্তানকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
লাবণ্যর বাবা আরিফুল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ৯ অক্টোবর নিজের গায়ে আগুন দেয় লাবণ্য। তারপর থেকে আজ (বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর) ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে কথা বলেছে সে। মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পর লাইফ সাপোর্টে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। আর কথা বলেনি লাবণ্য।
এর আগে, ৯ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটার দিকে স্বামী শেখ সাদী হোসায়েনের সঙ্গে কথা বলার পরপরই গায়ে আগুন দেয় লাবণ্য। প্রথমে তাকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক দিন পর সেখান থেকে তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
গায়ে আগুন দেওয়ার খবর লাবণ্যর শ্বশুরবাড়িতে দেওয়া হলেও তার স্বামী বা কেউ কোনো খোঁজ নেননি।
লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে লাবণ্য কেন এই পথ বেছে নিল, সে কথা জানিয়েছে তার মা–বাবাকে। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, মেয়ে জবাব দিয়েছে থেমে থেমে, অনেকটা বিরতি নিয়ে। তাদের ভাষ্যমতে, লাবণ্য বলেছে, ‘নিজেই দিছি...তুমরার জামাইয়ের কথার কারণে। অনেক খারাপ খারাপ কথা কইছে। বাঁচতে ইচ্ছা হইছিল না। এত খারাপ কথা বলে তো কী করমু? সাদীর সাথে কথা বলমু না। আসলেও দেখা করমু না। আমি চাই না হে এওনো আইয়ুক। আমি অনেক ভালা আছি’।
স্বামীর নির্যাতন প্রসঙ্গে লাবণ্য তার মা-বাবাকে জানিয়েছিল, ‘তুমার জামাই কইছে দাদুর কাছে কইছিলি টাকার কথা? আমি কইছি, না। বলে তোর তো সংসার করার ইচ্ছা নাই। সংসার করার ইচ্ছা থাকলে প্রতিষ্ঠিত কইরা দিতি। যা নয়, তাই কইছে। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, জামাই। এমনও দিন গেছে দুই–তিন দিন না খায়া থাকছি।’ ভালো হলেও আর কোনো দিন সাদীর কাছে ফিরবে না জানিয়েছিল লাবণ্য।
মেয়ের বরাত দিয়ে মা–বাবা জানান, লাবণ্যর গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর মাছ–মাংস–ডিম খাওয়া ছিল নিষেধ। ভাতের পাশে একটু ভর্তা আর ডাল। চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যায়নি ওরা। লাবণ্যর স্বামী জানিয়ে দিয়েছিল, চিকিৎসকের কাছে যেতে হলে দাদির বাড়িতে ফিরতে হবে। ওর বাবা কথা দিয়েছিলেন সাত–আট দিন পরে মেয়েকে নিয়ে যাবেন। সেই সময়ও তারা দিতে রাজি হয়নি। গর্ভবতী কিশোরীকে প্রচণ্ড মারধর করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। খবর পেয়ে আরিফুল ইসলাম মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন। গত ১ আগস্ট থেকে সে দাদির কাছেই ছিল।
লাবণ্যর শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায়। লাবণ্যকে সেখান থেকে এনে কলমাকান্দার গাখাজোড়া গ্রামে দাদির কাছে রেখে এসেছিলেন বাবা আরিফুল ইসলাম। পাঁচ দিন আগে ওই বাড়িতে থাকা অবস্থায় ফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হওয়ার পর গায়ে আগুন দেয় মেয়েটি।
লাবণ্য যখন বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে, তখন তার মা–বাবা, স্বজনেরা মেয়েটির জীবনের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে হিসাব কষছিলেন। তাঁরা একমত, ১৭ বছরের জীবনে মেয়েটি আসলে কিছুই পায়নি। মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর দুজনই দুজনের নতুন সংসারে ব্যস্ত ছিলেন। দাদা–নানির কাছে বড় হওয়া লাবণ্য ভেবেছিল, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধলে জীবনটা অন্য রকম হবে। কিন্তু মাস দুয়েক পর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় তাঁর অসুখী জীবনের। যৌতুকের জন্য স্বামী, শাশুড়ি নানাভাবে অত্যাচার শুরু করেন। ১৬ মাসের সংসারে দফায় দফায় সালিস হয়েছে শুধু, মীমাংসা হয়নি।
বাবা আরিফুল ইসলাম বলছিলেন, ‘জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর যদি একবার মেয়েটা আমার সঙ্গে কথা বলত, তাহলে এমন হতো না। বাবার জন্য সে পাগল ছিল। আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।’ বারবারই তিনি বলছিলেন, লাবণ্যই চায়নি তার স্বামীকে বাবা টাকাপয়সা দিক। মেয়ে তাঁর এই একটিই। পেশায় শিক্ষক আরিফুল পারিবারিকভাবে অবস্থাপন্ন।
মা আফরোজা ফাতেমা বললেন, ‘লাবণ্য গায়ে আগুন দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছিল, লাবণ্য খুব কষ্টে আছে। আমি মা, আমার একটা কিছু করা দরকার।’ আফরোজা ঢাকায় সেলাইয়ের কাজ করে কোনো রকমে টিকে আছেন। তবু মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। মেয়ে আর সেই সময় দেয়নি।
পাঁচ দিন ধরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন লাবণ্য। লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগপর্যন্ত সন্তানের খোঁজ নিয়েছে সে। মা–বাবার হাত ধরে হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে একটু উঠে দাঁড়াতে চেয়েছে। সকাল আটটায় হঠাৎ রক্তক্ষরণ শুরু হয়, জন্ম হয় মৃত কন্যাশিশুর। এই খবরটাও সে পায়নি, তার আগেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সে আর চোখ মেলে তাকায়নি, কথাও বলেনি।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন আইউব হোসেন দুপুরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ডাক্তারি যত রকমের চেষ্টা আছে, সবই চলছে। খুব বেশি আশা নেই।