বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় হঠাৎ শুরু হওয়া বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা। এই বছর এ নিয়ে তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে এসব জেলা।
সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা বলছেন, বহু বছরের মধ্যে তারা এতো মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। সবমিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে। এর মধ্যেই সুনামগঞ্জের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রেল যোগাযোগ।
এর পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরও অন্তত ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নদী গবেষকরা বলছেন, এবার এ রকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু কারণ রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ভারতের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে।বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে ওপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে। বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২ হাজার ৪শ ৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে এমন বৃস্টি হতে দেখা যায়। সেবার তিনদিনে ২ হাজার ৭শ ৯৮ মিলিমিটার বৃস্টিপাত হয়। এর আগে ১৯৭৪ সালে একবার এমন বৃস্টি হয়েছিলো।
সুনামগঞ্জ জেলার বাংলাদেশের সীমান্ত শেষ হওয়ার পর থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। সুনামগঞ্জে হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির এই প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চেরাপুঞ্জিতে আরও দুই তিনদিন বৃষ্টিপাত হলে বন্যার ধকল আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারাকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। আর এজন্য তারা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন।
নদী গবেষক মুমিনুল হক সরকার জানিয়েছেন, প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করছেন গবেষকরা।
এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এই গবেষকরা।
এবারের বন্যার পেছনে অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও দায়ী করা হচ্ছে। ''সিলেট এবং সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। পর্যাপ্ত জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে আশপাশ প্লাবিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনার হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোন কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে খুব দ্রুত পানি শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।
বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, ''হাওর এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি না করা দুঃখজনক। বাঁধ করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হচ্ছে।''