আগস্ট ২৩, ২০২২, ১০:৪১ পিএম
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার একটি গ্রামে খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা নিয়ে সংঘর্ষে সরকারি একজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
সোমবারের(২২ আগস্ট) ওই ঘটনায় সাতজন নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রামের অনেক বাসিন্দা গ্রেপ্তার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শত বছরের পুরনো একটি মাঠে প্রশাসন আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে চাইছে। তাহলে আশেপাশের ছয় গ্রামের জন্য আর কোন খেলার মাঠ থাকবে না।
তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, পতিত একটি জমিতে তারা আশ্রয়ণ প্রকল্প করার পরিকল্পনা করেছিলেন, পাশে অন্য একটি খেলার মাঠ রয়েছে।
খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা নিয়ে স্থানীয়দের বাধার ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
এর আগে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় বলাইশিমুল মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর তোলা নিয়ে স্থানীয়রা বাধা দেন। পরবর্তীতে সেখানকার খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার জন্য হাইকোর্ট আদেশ দেয়।
শাহজাদপুরে যা ঘটেছিল
শাহজাদপুরের বলদিপাড়া-হলদিঘরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে কাছাকাছি দুটি খেলার মাঠ রয়েছে। এর একটি ছোট, আরেকটা একটু বড়।
দু'মাস আগে স্থানীয় বাসিন্দারা জানতে পারেন যে, এর একটি মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর জুলাই মাসে তারা কয়েক দফা মানব বন্ধন ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, সেখানে স্কুলের পাশের মাঠটি সংস্কার করে খেলাধুলার জন্য থাকবে। আর অন্য মাঠটিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প হবে। তখন সেখানে একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছিল। সেই টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা।
শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''সোমবার আমরা সেখানে পরিদর্শনে গেলে হাজার হাজার মানুষ আমাদের ওপর হামলা করে। এর আগে এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, সমঝোতা হয়েছে। তারপরেও কেন তারা বাধা দিচ্ছেন বুঝতে পারছি না।''
ওই হামলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহত হন। ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
এরপর ভূমি অফিসের একজন কর্মকর্তা ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে আর অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১২০ জনকে আসামী করে থানায় একটি মামলা করেছেন। মাঠ রক্ষায় যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাদেরকেই প্রধানত ওই মামলায় আসামী করা হয়েছে।
সোমবার রাতেই পুলিশ সেই গ্রামে অভিযান চালিয়ে সাতজন নারীকে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় বাসিন্দারা কী বলছেন
মামলার পর থেকেই ওই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রতিদিন পুলিশ কয়েকবার সেই এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
গ্রেপ্তারের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বিবিসি বাংলাকে বলেন, দু'মাস আগে প্রথম তারা জানতে পারেন, গ্রামের খেলার বড় মাঠে গুচ্ছগ্রাম (আশ্রয়ণ প্রকল্প) হবে। এরপর থেকেই তারা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসন- সবার কাছে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি।
''এটা আমাদের আশেপাশের ছয় গ্রামের একটা খেলার মাঠ। স্কুলের পাশে আরেকটা ছোট মাঠ থাকলেও সেটা ফুটবল খেলার মতো বড় মাঠ না। যেটা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা দু'শো বছরের ঐতিহ্যবাহী মাঠ, এখানে আমার বাবা খেলছে, আমার দাদা খেলছে, আমাদের ছেলেমেয়েরা খেলছে।''
''এখন সেই মাঠে গুচ্ছগ্রাম হলে আমাদের ছয় গ্রামের কোন খেলার মাঠ থাকবে না। আমরা আমাদের গ্রামে গুচ্ছগ্রাম হতে দেবো না। তাহলে গ্রামের পরিবেশও থাকবে না,'' তিনি বলছিলেন।
তবে শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেছেন, সেখানে একই মৌজায় কাছাকাছি দুটি মাঠ রয়েছে। দু'টিই খাস জমি। তবে কাগজপত্রে স্কুলের পাশের জমিটি খেলার মাঠ, অন্যটি পতিত জমি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
''আমরা পতিত জমিটিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ নিম্নভূমি বা দূরের জায়গায় এসব ঘরবাড়ি করা হলে সেখানে কেউ আসলে থাকতে চায় না। প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রকল্পে ঘরবাড়ি করে দেয়া হবে, সেটা ভালো একটা জায়গায় হওয়া দরকার।
"এমপি মহোদয়ের সঙ্গে বৈঠকে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে যে, এখানে প্রকল্পের ঘরবাড়ি হবে, তারা অন্য মাঠটি তারা ব্যবহার করবেন। সেখানে একটা পুকুর আছে, সেটাও ভরাট করে দেয়ার কথা বলেছি। কিন্তু এখন তারা কেন আপত্তি করছেন বুঝতে পারছি না,'' তিনি বলেন।
হামলার সময় সহকারি কমিশনার (ভূমি) গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়া তার গাড়িও ভাঙচুর করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, যে জমিতে তারা আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে চান, সেখানে এক একর ২২ শতাংশ জমি রয়েছে, যেখানে ৬০টি ঘর তৈরি করা যাবে।
অন্য কোথাও এই প্রকল্প সরিয়ে নেয়া যায় কিনা, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, '' অন্য খাসজমিগুলো অনেক নিচু, সেখানে মানুষ বাস করবে না। ঘর তৈরি করে দেয়ার পর মানুষ বাস না করলে সেটা নিয়েও সমালোচনা হবে। আমরা চাই, যেখানে মানুষ বাস করতে পারবে এবং জনবহুল এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প করা, সেজন্যই আমরা এই এলাকাটি বেছে নিয়েছি।''
তবে স্থানীয় ওই বাসিন্দা বলছেন, ''ওই বৈঠকে গ্রামের মাত্র কয়েকজন লোক গিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে মাঠ ছেড়ে দিতে একপ্রকার জোর করে সম্মতি নেয়া হয়েছিল, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাতে একমত নন। তারা সেখানে বলে এসেছিলেন, আমাদের টুর্নামেন্ট শেষ হোক, তারপরে আপনারা যা করার কইরেন। কিন্তু আমরা কেউ এখানে খেলার মাঠে গুচ্ছগ্রামে রাজি না।''
তিনি জানান, এই মাঠে প্রতিবছর একাধিক টুর্নামেন্ট হয়। এটা বন্ধ হয়ে গেলে ছয় গ্রামের খেলাধুলা করার কোন মাঠ থাকবে না।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করা কেন হলো, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, গ্রামের বাসিন্দারা কোন হামলা করেননি। বরং এখন পুলিশের ভয়ে তারা গ্রামে থাকতে পারছেন না।
খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি প্রকল্প, যার মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন এবং যার জমি আছে ঘর নেই, এমন পরিবারের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হয়।এখন এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চলছে।
এবার সিরাজগঞ্জের আগে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় বলাইশিমুল খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তুলেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। পরবর্তীতে সেখানে আশ্রয়ণ কেন্দ্র বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরেও খেলার মাঠে এই প্রকল্প না করার জন্য ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।সূত্র: বিবিসি বাংলা