জুন ১৭, ২০২৫, ০১:১৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সরাসরি সংঘাত বিশ্ব রাজনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ইতিহাসে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যেকোনো যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত তেলের বাজার থেকে শুরু করে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল পর্যন্ত বহুমাত্রিক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ কিংবা সাম্প্রতিক রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ—সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে জ্বালানির সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে কিভাবে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক শক্তি। যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র হলে তেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ—হরমুজ প্রণালি—প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়। এই প্রণালির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, যার ধাক্কা সরাসরি পড়বে উন্নয়নশীল, আমদানি–নির্ভর দেশগুলোর ওপর—এর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।
এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশ্নটি—ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশ কতটা অনুভব করবে? কীভাবে তা দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে?
১. জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ ঝুঁকি
তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা: হরমুজ প্রণালি যদি সাময়িকভাবে বন্ধও থাকে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য এক ঝটকায় অনেক বেড়ে যাবে। অতীতে -১৯৭৩ ও ২০১৭ সালে –এমন ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের সরাসরি প্রভাব: দেশটি আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, বিশেষত এলএনজি ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের উল্লম্ফন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে, যা শিল্প, কৃষি, পরিবহন ও খুচরা পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।
এলএনজি সরবরাহ ঝুঁকি: কাতার ও ওমান থেকে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি করে, যার পরিবহন পথ হরমুজ প্রণালি। এই পথ বন্ধ হলে এলএনজি সরবরাহ বিঘ্নিত হবে এবং শিল্পে গ্যাসের সংকট তৈরি হবে।
২. মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধিতে চাপ
দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি: ইতিমধ্যেই দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম বাড়লে তা আরও তীব্রতর হবে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির আশঙ্কা: বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এর সঙ্গে নতুন করে মূল্যস্ফীতি যুক্ত হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।
স্ট্যাগফ্লেশনের ঝুঁকি: একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর। এই অবস্থাকে অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশন বলা হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতি তা আরও বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সংকোচনের মুখে ফেলতে পারে।
৩. রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব
রপ্তানি খাতে ঝুঁকি: বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা ব্যাহত হলে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব, ক্রয়াদেশ বাতিল, দাম কমাতে বাধ্য হওয়া এবং বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
৪. প্রবাসী আয় ও শ্রমবাজার সংকট
মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধপ্রবণ হলে: ইরান ও প্রতিবেশী অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ ও সেবা খাত স্থবির হয়ে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে।
ওমানের ওপর ঝুঁকি: ইরান বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স–দেশ না হলেও, হরমুজ প্রণালির পাশে অবস্থিত ওমান বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম রেমিট্যান্স উৎস। এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হলে আয় কমে যেতে পারে।
নতুন নিয়োগে বাধা: যুদ্ধের কারণে দেশগুলো নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ করতে পারে, বিমান চলাচল বিঘ্নিত হলে শ্রমিকদের যাতায়াতেও সমস্যা হবে।
৫. বিমান চলাচল ও লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধি
আকাশপথে প্রভাব: ইরানের আকাশপথ এড়িয়ে বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের বিমান খুব বেশি ইরানের আকাশ ব্যবহার করে না, তবে আঞ্চলিক রুটে খরচ ও সময় বাড়তে পারে।
টিকিটের দাম: এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রভাব না পড়লেও পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে খরচ বাড়তে পারে, সূচি পরিবর্তন করতে হতে পারে।
৬. নীতিগত করণীয় ও প্রস্তুতি
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কৌশলগত প্রস্তুতি নিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যেমন-
বিকল্প জ্বালানি উৎস খোঁজা
এলএনজি সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নিশ্চিত করা
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় আরও সতর্কতা
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নীতি গ্রহণ
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এমন এক সময় শুরু হয়েছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতি আগে থেকেই নানা অনিশ্চয়তা ও সংকটে নিমজ্জিত—বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, মুদ্রানীতির কঠোরতা প্রভৃতি কারণে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর জন্য এই যুদ্ধ নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।