আমদানি খরচের তুলনায় রপ্তানি আয় বা রেমিটেন্স প্রত্যাশিত মাত্রায় না বাড়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঘাটতিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য। এ অবস্থায় আমদানি ব্যয়ে লাগাম দেওয়ার তাগিদ দিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য ‘সময়োপযোগী নীতি’ প্রণয়ন জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুন-মার্চ) চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০৭ কোটি ডলার। ঘাটতির এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ গুন বেশি। গত অর্থবছর ৯ মাসে ঘাটতি ছিল ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর গত ২০২০-২০২১ অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৫৮ কোটি ডলার। তার আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৫৪৪ কোটি ডলার।
এত বেশি ঘাটতি হয়নি কখনও
দেশের ইতিহাসে লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এত বড় ঘাটতি আর কখনও হয়নি। এর আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ৯৫৬ কোটি ডলারের ঘাটতিই ছিল সবচেয়ে বড়। কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খরচ হচ্ছে বেশি। আগে যেখানে ১১-১২ মাসের বৈদেশিক দায় পরিশোধের সক্ষমতা ছিল, এখন তা আট মাসের নিচে চলে এসেছে।
পরিসংখ্যান কি বলছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মাসে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ৪ হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৩ হাজার ৬৬১ কোটি ডলার; যা আগের অর্থবছর একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৪৯১ কোটি ডলার। অর্থাৎ, এই নয় মাসে যেখানে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়েছে, রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। তাতে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের এই সময়ের চেয়ে প্রায় ৬৪ শতাংশ বেশি।গত অর্থবছরের এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আর পুরো অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭০৮ কোটি ডলার, ব্যয় হয়েছে ৯৮৯ কোটি ডলার। তাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৯৯ কোটি ডলার। এর ফলে সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৬৯৯ কোটি ডলার।
রয়েছে নির্দেশনা
আমদানি পণ্যর লাগাম টানতে গত ১১ এপ্রিল একটি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ন্যূনতম ২৫ শতাংশ নগদ মার্জিন রাখতে বলা হয় ব্যাংকগুলোকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৫৯৮ কোটি ডলার, যা আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ৩৩০ কোটি ডলার কম। অর্থাৎ, নয় মাসের হিসাবে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ রেমিটেন্স কম এসেছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেমিটেন্স বাবদে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার দেশে এসেছিল, তাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ শতাংশ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসিড ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, শুধু যে বেসরকারি আমদানি বেড়েছে তা নয়, সরকারি পর্যায়েও আমদানি বেড়েছে। আবার সরকার বৈদেশিক দায় পরিশোধও করছে। এতেই চলতি হিসাবের ঘাটতি বড় হচ্ছে। এভাবেই বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থাপনায় একটি কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। সরকারকে এখন বৈদেশিক ঋণের সঠিক ব্যবহ্যারে বেশি নজর দিতে হবে।
ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার বিদেশি মুদ্রার সঞ্চায়ন ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি, অথচ ২০২১ সালের অগাস্টে রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। গত বছরের এপ্রিল ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা; চলতি বছেরর একই সময়ে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা হয়। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা করলেও তা সম্ভব হয়নি। গত মার্চ শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।