লকডাউন : দেশীয় শিল্পে বড় আঘাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

এপ্রিল ১৪, ২০২১, ১১:৪৫ পিএম

লকডাউন : দেশীয় শিল্পে বড় আঘাত

করোনা সংক্রমণ রোধে দ্বিতীয় দফা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদকেরা। দোকানপাট সব বন্ধ করে দেওয়ায় দেশীয় পণ্যের বাজার অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে। দোকান বন্ধ বিধায় পণ্য বিপণনের সুযোগ নেই। যার ফলে উৎপাদন করেও লাভ নেই বলে জানায় ব্যবসায়ীরা।

দেশে উৎপাদিত ও বিপণনকৃত পণ্য পাদুকা,পোশাক,নির্মানসামগ্রীসহ নানা খাত এখন উৎপাদন হ্রাস করে দিয়েছে। দোকান ও মার্কেট বন্ধ থাকায় পণ্য উৎপাদন করে সেগুলো বাজারজাত করা যাচ্ছে না। যার ফলে কারাখানা খোলা রাখার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ শ্রমিকদের কাজ নেই। একইভাবে পুরান ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাদুকাপল্লিগুলো সমস্যায় পড়েছে। তারা সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের চপ্পল ও জুতা তৈরি করে। ছোট এই শিল্প খাতে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। এই খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের আগে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য তৈরি জুতার রমরমা ব্যবসা থাকে। লকডাউনের কারণে তা হচ্ছে না।

নির্মান শিল্পের অবস্থা

রড-সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রীতেও দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি দেশের অন্যতম ভারী শিল্প খাতও। রড-সিমেন্টের প্রায় পুরো চাহিদাই পূরণ করেন স্থানীয় উৎপাদকেরা। বর্তমানে দেশে ৩৫টির মতো দেশি–বিদেশি সিমেন্ট কারখানা উৎপাদনে আছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তারা সিমেন্ট রপ্তানিও করছে। এই শিল্পের সঙ্গে লক্ষাধিক শ্রমিক–কর্মচারী জড়িত। দেশে বছরে সিমেন্টের চাহিদা প্রায় চার কোটি টন, যার পুরোটাই স্থানীয় কারখানাগুলো সরবরাহ করে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের প্রধান কার্যালয় বন্ধ থাকবে, তবে কারখানা চালু থাকবে। কারখানা চালু থাকলেও সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলে আমাদের পণ্য মজুত করতে হবে। মজুত রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ফুরিয়ে গেলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হব। আগামী দু–তিন দিন পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হলে কারখানা বন্ধ করা হবে।’

নির্মাণ খাতের আরেক অপরিহার্য সামগ্রী রড। এই রডের বাজারও সংকটে পড়বে। উৎপাদকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বহু প্রতিষ্ঠান দুই শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালুর পরিকল্পনা করছে। পরিবেশক বা খুচরা পর্যায়ে দোকানপাট এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ থাকলে কারখানাও বন্ধ রাখার বিকল্প নেই।

বর্তমানে দেশের প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান বছরে ৬০ লাখ টনের মতো রড উৎপাদন করে। তারা স্থানীয় চাহিদার পুরোটাই পূরণ করে। আবার রপ্তানিও হয়।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা এ কে মাসাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকলে একদিকে রডের কাঁচামালের সংকট হবে, অন্যদিকে বাজারে চাহিদা কমে যাবে, বিক্রিও কমবে। খরচ কমাতে প্রথম কয়েক দিন কারখানা এক শিফটে চালাব, পরে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।’

ঈদের আগের এই সময়ে পাইকারি বাজারগুলো জমজমাট থাকে। কারখানাগুলো দিনরাত চলে, কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ায় হয়তো আগামী দু-তিন দিন কারখানা চালানো যাবে। এরপরে বিক্রি করব কোথায়?

দেশীয় পোশাক উৎপাদনকারীদের বড় ক্ষতি

স্থানীয় বাজারে প্রায় শতভাগ কাপড়ের চাহিদা মেটায় দেশের বস্ত্রকলগুলো। সারা দেশে এখন ছোট-বড় তিন হাজার বস্ত্রকল আছে। এই খাতে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। সরকারঘোষিত বিধিনিষেধে দেশি বস্ত্রকলগুলো ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদের আগে এই সময়েই কাপড়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। শুধু নরসিংদীসহ সারা দেশের বস্ত্রকলগুলো থেকে কাপড় প্রথমে নরসিংদীর বাবুরহাট, নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে যায়। সেখান থেকে সারা দেশে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়। দেশে মাথাপিছু কাপড়ের চাহিদা ২৫ মিটার। এর প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করে এসব কারখানা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঈদের আগের এই সময়ে পাইকারি বাজারগুলো জমজমাট থাকে। কারখানাগুলো দিনরাত চলে, কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ায় হয়তো আগামী দু-তিন দিন কারখানা চালানো যাবে। এরপরে বিক্রি করব কোথায়? তখন বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ করতে হবে।’ তিনি মনে করেন, দোকানপাট সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হলেও বস্ত্রকলের মালিকেরা পার পেয়ে যাবেন।

পুরাতন পণ্য কেনাবেচা ভাল

তবে দেশীয় পণ্য কম চললেও পুরাতন পণ্য কেনাবেচ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। লকডাউনের কারনে অনেকেই গ্রামমুখী হওয়ায় আসবাবপত্র, ফ্রিজসহ নানাভারী জিনিস সুলভ মূল্যে বিক্রি করে যাচ্ছে। এছাড়া আর্থিক সংকটের কারনেও অনেকেই পণ্য বিক্রি করে দিচ্ছে। যার ফলে পুরাতন পণ্যের ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্ধেকেরও চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে এই সব পণ্যগুলো।

এদিকে পুরাতন পণ্য কেনা-বেচা নিয়ে অনেক গ্রুপ গড়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রিসাইকেল বিন নামে বেশ কয়েকটি গ্রুপ দেখা যায় ফেসবুকে। যেখান থেকে পুরাতন যাবতীয় পণ্য কেনা বেচা চলছে।

Link copied!