বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। এরমধ্যে বেশিরভাগই জীবন-জীবিকা-পরিবার চক্রে আটকে পড়েন সারাজীবনের জন্য। জীবনের চিরন্তন চক্র ভেঙে বাইরে এসে বিশ্বকে দেখার স্বপ্ন পূরণে নামতে পারেন খুব কম মানুষই। চাকরি-সংসার সবকিছু রেখে বিশ্ব ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে গেলেন এক দম্পতি। সঙ্গী দুই সন্তান।
২০২৩ সালের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে বিশ্ব ভ্রমণে বের হয়েছে ম্যাট প্রায়র ও লিয়া প্রায়র। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই বিশ্বভ্রমণে বের হওয়ার আগে তারা চাকরি তো ছেড়েছেনই এমনকি তাদের সব সহায়সম্পত্তিও বেচে দিয়েছেন। তারপর তিন বছর বয়সী জ্যাক আর এক বছরের শার্লেটকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বিশ্বভ্রমণে।
মূল ভ্রমণের আগে জ্যাক এবং শার্লেটকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে কয়েকটি লম্বা দূরত্বের পরীক্ষামূলক ভ্রমণ করেন ম্যাট এবং লিয়া। এই ভ্রমণ এবং ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে সন্তানদের বিশ্ব ভ্রমণ এবং মোবাইল, টিভির মতো বিষয় ছাড়া আনন্দময় সময় কাটানোতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন তারা।
বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া ব্রিটিশ ম্যাট আর আমেরিকান লিয়ার কাছে নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালে এক ভ্রমণেই দেখা হয় দুজনের। সে সময় ম্যাট একটা লন্ডন ব্ল্যাক ক্লাব গাড়ি চালিয়ে বিশ্ব ঘুরে ব্রিটিশ রেডক্রসের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন। অন্যদিকে লিয়া দক্ষিণ কোরিয়ায় কয়েক বছর শিক্ষকতা করে এক বছরের বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।
সেই দেখা থেকেই প্রণয়। এক বছর পর হংকংয়ে একসাথে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। হংকংয়ে লিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করার পাশাপাশি স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। ম্যাট এ সময় বিমান চালনা, একটি রোমাঞ্চ ঘরানার ট্রাভেল কোম্পানির সহ-উদ্যোক্তা, হংকং এক্সপ্লোরারস ক্লাবের পরিচালকের দায়িত্ব পালনসহ আরও অনেক কিছু করেন।
২০১৯ সালে হংকংয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে একটি অর্গানিক খামার করার কথা ভাবেন এই দম্পতি। কিন্তু সে সময় বিশ্বে হানা দিলো করোনা মহামারি। হংকংয়ে আটকে গেলেন তারা। জন্ম হলো পুত্র জ্যাকের।
২০২২ সালেও হংকংয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক না হওয়ায় আবার অন্তঃসত্ত্বা লিয়া সাময়িকভাবে পাড়ি জমালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে সময় ম্যাট হংকংয়ে থেকে যান। পরে কন্যা শার্লেট জন্মানোর আগে আমেরিকায় চলে যান।
লিয়ার সাথে পরিচয়ে আগে বিশ্বভ্রমণের সময় ম্যাটের দেখা হয় এক দম্পতির সাথে যারা ১৯২৮ মডেলের একটি ক্ল্যাসিক গাড়িতে ২২ বছর ধরে বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছিলেন। এই ভ্রমণের সময় তাঁদের চার সন্তান হয়।
দুই সন্তানকে লালনপালনের সময় আবারও সেই দম্পতির দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনে আসে ম্যাট-লিয়ার। তারাও এমন কিছু করার জন্য পরিকল্পনা শুরু করেন। ‘প্রজেক্ট ওয়াইল্ড আর্থ’ যাত্রা শুরু করলো তখনই। পরিবার নিয়ে স্থলপথে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন তারা।
সে সময় বিখ্যাত প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ এবং সংরক্ষক ড. জেন গুডউইল অনুপ্রাণিত করেন ম্যাট ও লিয়াকে। চলার পথে সময়টা কীভাবে কাজে লাগাবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নিজেদের আগ্রহ এবং মূল্যবোধের দিকে আবার নজর দিলেন দুজন।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত প্রকল্পগুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি তাঁদের পরিবার কীভাবে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা অনেক লোকের সাথে কথা বলেন।
তাঁরা বিশ্বব্যাপী ২৫০টির বেশি প্রকল্পের একটি তালিকা করেন, যেগুলোতে তাঁরা চলার পথে কাজ করবেন। এগুলোর মধ্যে আছে আদিবাসীদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া, প্রকৃতিনির্ভর পর্যটন, বন্যপ্রাণী তদারকি ও সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি প্রকল্প।
কৃষি বনায়ন, পুনরুৎপাদনশীল কৃষির ওপর জোর দেওয়ার বিষয়ে প্রকল্প সাজান তারা।
দ্য জেন গুডউইল ইনস্টিটিউট এবং রুটস অ্যান্ড শুটস নামের দুটি সংগঠনের পরামর্শ নিয়ে স্টোরিটেলিং বা গল্প বর্ণনার মাধ্যমে সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন এই দম্পতি।
গাড়ি চালিয়ে এই ভ্রমণ করবেন বলে যে কার্বন নিঃসরণ হবে সেটির ক্ষতি পুষিয়ে দিতেও কাজ করবেন তারা।প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন মসি আর্থের মাসিক সদস্য হবেন তারা। পাশাপাশি পাঁচ বছরের এই ভ্রমণে সি গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস সংরক্ষণেও কাজ করবেন।
লন্ডন থেকে একটি ইনিয়েস গ্রেনেডিয়ার ফোর হুইলার গাড়িতে যাত্রা শুরু করেছেন তাঁদের। এর সঙ্গে জোড়া লাগানো আছে প্যাট্রিয়ট কমপ্লেক্স এক্স-৩ নামের একটি ট্রেইলার। আগামী পাঁচ বছরে শতাধিক দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা ম্যাট-লিয়ার। পথে বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্ক ও সংরক্ষিত অঞ্চলে থামবেন এবং পরিবেশগত ও সামাজিক বিভিন্ন উদ্যোগে সাহায্য করবেন।
ভ্রমণের সময় ন্যাশনাল পার্কের বিভিন্ন রেঞ্জার, সহায়তাকারী সংস্থা, সরকারি কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের সাথে তাঁদের দেখা হবে। ‘প্রজেক্ট ওয়াইল্ড আর্থ’ নিয়ে তাদের জানাবেন এই দম্পতি। সেসব গল্প নিজেদের ওয়েবসাইটে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরবেন।
ভ্রমণ ও সংরক্ষণের কাজে সন্তান জ্যাক ও শার্লেটকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে যতটা সম্ভব বৈচিত্র্য, উদ্ভাবনী ধারণা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত করাতে পারবেন বলে আশা করছেন এই দম্পতি। পাশাপাশি সন্তানদের প্রকৃতি ও অন্যদের সাহায্য করা শেখাবেন তারা।
যুক্তরাজ্য ভ্রমণ শেষে ম্যাট-লিয়া পেরোবেন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য। তারপর মধ্য এশিয়া, চীন, হিমালয় অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা হয়ে ভ্রমণ করবেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা।