দ্বিতীয় দিনও জ্বলছে হংকংয়ের বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, নিহত বেড়ে ৪৪

ইউএনবি

নভেম্বর ২৭, ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম

দ্বিতীয় দিনও জ্বলছে হংকংয়ের বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, নিহত বেড়ে ৪৪

বৃহস্পতিবার দুপুরেও ভবনগুলোর ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। ছবি: এপি

দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন

আগুন লাগার এক দিন পরও হংকংয়ের তাই পো এলাকার বহুতল ওয়াং ফুক কোর্ট ভবন কমপ্লেক্সের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরেও ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।

বুধবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে এই আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডে ইতোমধ্যে যেখানে অন্তত ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীও আছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৬২ জন।

এ ঘটনায় একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও একজন প্রকৌশল পরামর্শদাতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি পুলিশ।

এ ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট আইলিন চুং বলেছেন, ‘আমরা ধারণা করছি, নির্মাণ কোম্পানিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের গুরুতর অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’

ভবন কমপ্লেক্সের সংস্কার কাজের দায়িত্বে থাকা প্রেস্টিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কার্যালয়ও আজ (বৃহস্পতিবার) তল্লাশি করেছে পুলিশ। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে থেকে নথিপত্রভর্তি বাক্স জব্দ করা হয়েছে। তবে প্রেস্টিজের অফিসে ফোন করা হলেও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের সেই ফোনকলে কেউ সাড়া দেয়নি।

কর্তৃপক্ষের ধারণা, বহুতল ভবনগুলোর বাইরের দেওয়ালে এমন কিছু নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল, যেগুলোর অগ্নিরোধী মান ছিল না। এ কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিকাণ্ডের পরও অক্ষত থাকা পাশের একটি ভবনের প্রতিটি তলার লিফট লবির জানালার পাশে স্টাইরোফোম পেয়েছে পুলিশের তদন্ত দল, যা অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। ধারণা করা হচ্ছে, নির্মাণ কোম্পানিই এগুলো লাগিয়েছিল, কিন্তু এসব স্টাইরোফোম ব্যবহারের উদ্দেশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। এগুলো নিয়ে আরও তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন হংকংয়ের নিরাপত্তা সচিব ক্রিস ট্যাং।

বুধবার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে এই আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ছবি: সংগৃহীত

কমপ্লেক্সের ৩২ তলা একটি ভবনের বাইরের স্ক্যাফোল্ডিং (বাঁশ, কাঠ বা লোহার কাঠামো) থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর বাঁশের মাচা ও নির্মাণ জালে ধরে আগুন ভবনের ভেতরে এবং তারপর পাশের ভবনগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় আবার জোরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল, ফলে আগুন দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উঁচু ল্যাডার ট্রাক থেকে আগুনে পানি ছিটিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন, কিন্তু ভবনের ভেতরে আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক ডেরেক আর্মস্ট্রং চ্যানের ভাষ্যে, ‘ভবনগুলোর ভেতরের তাপমাত্রা ছিল ভয়ানক রকমের বেশি। আমাদের পক্ষে ভবনে প্রবেশ করে উপরের তলাগুলোতে উঠে অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযান চালানো সহজ ছিল না।’

গতকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের উদ্ধার অভিযান চালাতে দেখা গেছে। এই অভিযান অন্তত আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে বলে বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এই আবাসন কমপ্লেক্সে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ বাসিন্দার জন্য আটটি ভবনের ২ হাজারের মতো ফ্ল্যাট রয়েছে। বাসিন্দাদের একটি বড় অংশই বয়স্ক। ১৯৮০-এর দশকে নির্মিত এই ভবনগুলো সম্প্রতি বড় ধরনের সংস্কারকাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

গতকাল বিকেলে আগুন লাগার পর রাতের মধ্যে প্রায় ৯০০ জনকে ভবনগুলো থেকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। হংকংয়ের নেতা জন লি জানান, মোটামুটি রাত ১২টা পর্যন্ত ২৭৯ জন বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। উদ্ধারকাজ চলতে থাকায় বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এখনও কতজন নিখোঁজ রয়েছে, সে বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

অগ্নিকাণ্ডের কারণে কমপ্লেক্সের অদূরে আশ্রয় নিয়েছে বহু পরিবার। ছবি: এপি

মাঝরাতে কথা হয় কমপ্লেক্সের বাসিন্দা লরেন্স লির সঙ্গে। তিনি তখন তার স্ত্রীর ব্যাপারে খবর জানতে উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। লি ভবন থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছালেও তার স্ত্রী তখনও তাদের ফ্ল্যাটে আটকে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পর আমি ফোন করে ওকে (স্ত্রী) বাসা থেকে বের হয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ফ্ল্যাট থেকে বের হতেই করিডর ও সিঁড়ি ধোঁয়ায় ভরে যায়; মুহূর্তেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। তাই ও আর সামনে এগোতে না পেরে আবার ফ্ল্যাটে ফিরে যায়।’

আরেকটি ভবনের বাসিন্দা উইন্টার ও স্যান্ডি চুং বলেন, গত রাতে বের হওয়ার সময় তাদের চারদিকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ উড়ছিল। তারা বেঁচে গেলেও ঘরবাড়ি নিয়ে শঙ্কায় আছেন। আজ ৭৫ বছর বয়সী উইন্টার চুং বলেন, ‘সারা রাত এক মুহূর্তও ঘুমাতে পারিনি।’

জন লি জানান, সরকার এই দুর্যোগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এবং শহরের আইনসভার (লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রচার বন্ধ রাখবে। নির্বাচন পেছানো হবে কিনা, সে বিষয়ে কয়েকদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

এদিকে, ফায়ার সার্ভিসের নিহত সদস্যের প্রতি শোক প্রকাশ করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি। হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।

কয়েক দশক সময়ে হংকংয়ের সবচেয়ে প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড এটি। এর আগে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে কাউলুনের একটি বাণিজ্যিক ভবনে লাগা আগুনে ৪১ জন নিহত হয়। সেই আগুন প্রায় ২০ ঘণ্টা স্থায়ী ছিল।

Link copied!