ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবায় নতুন দিগন্তের সূচনা করতে যাচ্ছে ইলন মাস্কের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দেশে গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন স্থাপনে সহায়তা করছে।
স্টারলিংক কী
স্টারলিংকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে, যখন স্পেসএক্স ঘোষণা দেয় তারা বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে এক বিশাল স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। ২০১৮ সালে প্রথম প্রোটোটাইপ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয় এবং ২০১৯ সালের মে মাসে প্রথম ৬০টি অপারেশনাল স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানো হয়। ২০২০ সালের মধ্যে স্টারলিংক বেটা টেস্টিং শুরু করে এবং প্রথমবারের মতো উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের গ্রাহকদের জন্য সেবা চালু করে। ২০২১ সালে এটি গ্লোবাল কভারেজ অর্জন করে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে ইন্টারনেট পরিসেবা প্রদান করছে।
বাংলাদেশে স্টারলিংক: ডিজিটাল রূপান্তরে এক নতুন দিগন্ত
স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছে এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভূমি বরাদ্দ, নির্মাণ সহায়তা ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের মতো কার্যক্রম পরিচালনায় এসব সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে, যা শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দেবে। স্টারলিংক দেশের শহর, প্রত্যন্ত অঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করবে। এর মাধ্যমে লোডশেডিং বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও ইন্টারনেট সচল থাকবে। যার ফলে উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার, এনজিও ও এসএমই ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও ডিজিটাল অর্থনৈতিক উদ্যোগ ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৯ ফেব্রুয়ারি স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা ও স্পেসএক্সের সিইও ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যাতে তিনি স্টারলিংক স্যাটেলাইট সেবা চালুর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন।
স্টারলিংক দেশের ইন্টারনেট সেবায় যেসব বদল ঘটাতে পারে
স্টারলিংকের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো সহজ হবে, যা ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা দেশের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু হওয়া দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে একটি মাইলফলক। এটি দেশের ইন্টারনেট সেবার মান উন্নত করতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে সহায়ক হবে।
সাধারণত ইন্টারনেট সংযোগ পেতে ফাইবার অপটিক বা মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু স্টারলিংক সরাসরি মহাকাশে স্থাপিত লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে, যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম বিলম্বে এবং উচ্চগতির সংযোগ দিতে সক্ষম।
ফাইবার অপটিক সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল। সাবমেরিন ক্যাবল হলো বিশ্বজুড়ে মহাসাগর ও সমুদ্রের নিচ দিয়ে বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের একটি নেটওয়ার্ক, যা এক দেশ থেকে আরেক দেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ ও ডেটা স্থানান্তর নিশ্চিত করে। বর্তমানে ৪০০টিরও বেশি সাবমেরিন ক্যাবল মহাসাগরের নিচে বিস্তৃত, যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ লাখ কিলোমিটার। যার মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্বের ৯৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ট্রাফিক পরিচালিত হয়।
কিন্তু সাবমেরিন ক্যাবলগুলো সমূদ্রের নিচে থাকায় ভূমিকম্প, সুনামি কিংবা অগ্নুৎপাত এর সেবাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। তাছাড়া সাবমেরিন কেবল থেকে গ্রাহক পর্যায়ে সাধারণত অপটিকাল ফাইবার কেবলের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করা হয় যা প্রায়শই প্রাকৃতিক দূর্যোগে বাধাগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট পরিসেবা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার ওপরে কক্ষপথে অবস্থান করে, যা প্রচলিত ভূ-স্থির কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলোর তুলনায় অনেক নিচে। এর ফলে ডেটা ট্রান্সমিশনের বিলম্ব কম হয় এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা প্রদান, সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে নিরাপদ ইন্টারনেট সংযোগ, দুর্যোগ পরবর্তি সময়ে দ্রুত ইন্টারনেট পরিসেবা চালু করা, ব্যবসা ও কর্পোরেট সেক্টরে দ্রুতগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট প্রদানসহ নানা খাতে স্টারলিঙ্ক তাদের ইন্টারনেট পরিসেবা প্রদানে সক্ষম।
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ও গণঅভ্যুত্থান
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংগঠিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় গণবিক্ষোভ প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট জনসাধারণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এক বিশাল ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম, চিকিৎসা খাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে এবং নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের অধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করে।
স্টারলিংক সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীনভাবে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে, কারণ এটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক এবং কোনো নির্দিষ্ট দেশের স্থলভিত্তিক নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। যার ফলে দেশে স্টারলিংক-ভিত্তিক পরিসেবা চালু হলে ভবিষ্যতে সরকার চাইলেই ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করতে পারবে না যার ফলে ইন্টারনেটের মতো একটি নাগরিক চাহিদা অব্যহত থাকবে।
বিভিন্ন দেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম
স্টারলিংক ইতোমধ্যে ইউক্রেন, ইরান, আফগানিস্তান ও বিভিন্ন যুদ্ধপ্রবণ অঞ্চলে সংকটকালীন সময়ে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এটি ডিজিটাল স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতিতে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগের নিশ্চয়তা দেবে।
তবে সরকার স্টারলিংকের কার্যক্রমের ওপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে এবং এটি দেশে আইনগত ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে কীভাবে ব্যবহৃত হবে সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।
তবে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য স্টারলিংকের আগমন একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।