বাংলা কবিতায় ছয় দফা

আব্দুল্লাহ আল হাদী

জুন ৮, ২০২১, ০৪:৩২ এএম

বাংলা কবিতায় ছয় দফা

সাহিত্য যুগে যুগেই ইতিহাসের নিভৃত সাক্ষী হয়ে থাকে আর সাহিত্যের অন্যতম নিবিড় উপাদান হচ্ছে কবিতা। ইতিহাসে ১৯৬৬ সাল যদিও বর্তমান থেকে বেশি দূরে নয়, তবুও দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শুদ্ধ ইতিহাস চর্চা রুদ্ধ থাকায় তা ধীরে ধীরে বেশ দূরের হয়ে গিয়েছিল। এখন সময় এসেছে সেগুলোকে সহজ করে জানবার। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার সময়ের কবিতায় ইতিহাস ও শব্দগত উপাদান কেমন ছিল।

১। কবিতা– ‘হলুদ চোখ’

‘অভাব জোকের মতো নির্দয় তৃষ্ণায় চুষে খায় হৃদয়ের ক্ষত,

গাছের হলুদ পাতা, জনতার হলুদ চোখেও, দেখে নিও, একদিন হবে।

তোমার জিহ্বার মতো লাল হবে সংগ্রামের ব্যতিক্রম লালে।

কোনদিন চাইনি কিছুই, আজ কিছু রক্ত চাই, প্রেয়সী গো,

চেয়ে দেখো বাঙালির চোখগুলি রক্তহীন ভীষণ হলুদ।’

২। কবিতা- ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’

‘চন্দ্রের স্নিগ্ধতা নয়, উত্তপ্ত সূর্যের আলো চাই।

বসন্তের শান্ত বাতাস চাই না,

চৌত্রের রৌদ্রদগ্ধ দিনগুলোই কাম্য হোক,

জনতার তৃপ্তি হোক বৈশাখের বৈকালিক ঝড়ে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ধমকে উঠল

সমুখের সারির ঐ সংগ্রামী ছেলেটা;

শীতের রোগীর মতো জবুথবু নয়,

গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে।’

‘গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে।’ কবিতাটির এই লাইনটি আরেকবার পড়ি, এখানে গঞ্জ বলতে নারায়ণগঞ্জকে বুঝানো হয়েছে। ঐ সময়ের পত্রপত্রিকা থেকে দেখা যায়, ৭ জুন, আহুত হরতালে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ১০ জন মারা যায়- সরকারি প্রেস নোট।

প্রকৃত পক্ষে কতজন মারা গিয়েছিল তা বঙ্গবন্ধু মুজিবের কারাগারের রোজনামচা থেকেও কিছুটা জানা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে। এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো। যারা আহত হয়েছে তাদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, '১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?'।

১৯৬৫ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করার পর তা যথারীতি তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন। ফিরে এসে তিনি সারা দেশে বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মতো জনতার ভিড়ে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত ৬ দফার সমর্থনে তিনি শেষ ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভা করেন। তাঁর শেষ জনসভাটি ছিল ৮ মে, নারায়ণগঞ্জ চাষাড়ার মাঠে। লাখো মানুষের ঢল বিছিয়ে গিয়েছিল সেখানে। এবং ঐ দিন রাতেই তাঁকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার ফলাফলও তীব্র আকার ধারণ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

১০ মে, ইত্তেফাকে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা ৬ দফা কি কারণে সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তা নিয়ে এক লেখা লেখেন। ১৩ মে, বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে প্রতিবাদ দিবস পালন করে আওয়ামী লীগ। সেই সমাবেশেই ৭ জুন, ৬ দফা দাবি ও বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়। এরপর ২০ মে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭ জুন পূর্ব-পাকিস্তানব্যাপী হরতাল পালনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

৭ জুনের ধর্মঘটে ওইদিন নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, টঙ্গী ও তেজগাঁওয়ে পুলিশ ও ইপিআর’র গুলিতে মনু মিয়া, আজিজুল্লাহ, মুজিবুল হক, শফিক, সামসুল হকসহ শতাধিক লোক নিহত হয়। ৮০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আহত হয় হাজারো। পুলিশ শুধু প্রেস নোটে ১o জন নিহতের কথা স্বীকার করে।

৬ দফা ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন যারা শহীদ হয়েছিল তাঁরা হয়ত ৬ দফার কোন-কোন দফায় কি-কি আছে তা তাঁরা ভালো করে জানতোও না। কিন্তু তাঁরা শেখ মুজিবকে ভালো করে জানত। পুরো বাঙালিই কেবল শেখ মুজিবকেই জানত। এজন্য সেই সময়ে আইয়ুব খানের তীব্র ফ্যান মওলানা ভাসানীসহ আওয়ামী দলের অভ্যন্তরেও অনেকে ৬ দফার প্রশ্নে নতুন ৮ দফা ঘোষণা করে জনতাকে দ্বিধান্বিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনতা আসলে দফা-টফা বুঝত না, তারা বুঝত শেখ মুজিবকে। তার প্রমাণ যেন ১৯৬৬ লেখা বাংলা কবিতাগুলোতেও রয়ে গিয়েছে।

নির্মলেন্দু গুণের সুবর্ণ গোলাপের জন্য কবিতাটিতে আমরা দেখি-

‘কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল,

কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ধমকে উঠল

সমুখের সারির ঐ সংগ্রামী ছেলেটা।' (এবং এর পরের লাইন)

‘'শীতের রোগীর মতো জবুথবু নয়, গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে।' অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জ যেখানে বঙ্গবন্ধু ছেষট্টি সালে ৬ দফার শেষ জনসভাটি করতে পেরেছিলেন।

লেখক: আব্দুল্লাহ আল হাদী

কবি ও গবেষক

 

 

Link copied!