মধ্যবিত্তের জন্য বাজেটে খুব একটা স্বস্তির খবর নেই: বাজেট বিশ্লেষণ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ১২, ২০২২, ০৫:৩৬ পিএম

মধ্যবিত্তের জন্য বাজেটে খুব একটা স্বস্তির খবর নেই: বাজেট বিশ্লেষণ

মধ্যবিত্তের অনেকেই আশায় ছিলেন, বাজেট তাঁদের স্বস্তি দেবে। অথচ বাজেটের কারণে বাড়বে ভোগান্তি, অনেক ক্ষেত্রে করতে হবে বাড়তি খরচ। গত কয়েক মাসের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে ভোগান্তি বেড়েছে। অনেকে আশায় ছিলেন, বাজেটে তাঁদের ভোগান্তি কমাতে কোনো কিছু থাকবে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানোর তেমন উদ্যোগ নেই, বরং বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব তাদের বাড়তি চাপে ফেলতে পারে। এতে পদে পদে ভোগান্তি বাড়বে, খরচও বাড়বে।      

শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ফ্রিজের মতো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, যা মধ্যবিত্তের খরচ বাড়াতে বাধ্য করবে। আবার সঞ্চয়পত্র কেনা ও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও শর্ত কঠিন করা হয়েছে। সারা বছরের আয়-ব্যয় জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দিতে হবে। রিটার্নের রসিদ না দেখালে ঋণ পাবেন না, সঞ্চয়ও করতে পারবেন না। মূল্যস্ফীতির চাপে সীমিত আয়ের মানুষদের সংসার খরচ বেড়েছে। তাঁদের কিছুটা স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো হয়নি বাজেটে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ নিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে মধ্যবিত্তের প্রধান সমস্যা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তাদের একটু স্বস্তি দিতে বাজেটে কিছু নেই, বরং তাদের অতিরিক্ত চাপের মধ্যে ফেলা হয়েছে। রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় তাদের জীবনযাপন আরও কঠিন হবে। কিছু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাড়তি শুল্ক-কর আরোপ করার ফলে তাদের খরচ বাড়বে। বাজেট দেখে মনে হয়েছে, মধ্যবিত্তের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় আনা হয়নি। মূল্যস্ফীতিকে শুধু স্বীকার করা হয়েছে, সমাধান নেই।

বাজেটের নতুন নতুন শুল্ক-কর প্রস্তাব ও শর্তগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মধ্যবিত্তের জীবনে ভোগান্তি বাড়াবে। এবার দেখা যাক কোথায় কোথায় তাদের চাপ বাড়ল। এক বছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম বেশ বেড়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে আছে। এর মানে, জীবনধারণের খরচ এক বছরের ব্যবধানে ৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

ফলে আগের মতো বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার বেশি হলেই কর দিতে হবে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে কিছুটা স্বস্তি মিলত। মধ্যবিত্তকে স্বস্তি দেওয়ার বদলে কর আহরণকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এই শ্রেণির দিকে সুনজর দেননি তিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রিটার্ন জমা না নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান এই ৩৮ সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ওই ৩৮টি সেবার মধ্যে বেশ কিছু মধ্যবিত্তের জীবনঘনিষ্ঠ। যেমন ব্যাংকঋণ পাওয়া, সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যবসা, রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরগাড়ি দেওয়া ইত্যাদি। এমনকি সন্তানকে ইংরেজি সংস্করণে (ইংলিশ ভার্সন) পড়াশোনা করালেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। এসব সেবা পেতে একবার করজালে ঢুকলে প্রতিবছর নিজের আয়-ব্যয়ের বিবরণী এনবিআরে জমা দিতে হবে। মেয়ের বিয়ে, অসুখ-বিসুখসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংকঋণ নেন মধ্যবিত্তরা। এবার বাজেটে সেই পথকে কঠিন করে তোলা হয়েছে। যেমন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণের আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে চাইবেন ঋণ আবেদনকারী আয়কর রিটার্ন দিয়েছেন কি না। রিটার্ন জমার রসিদ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা না দিলে ঋণ দেবে না ব্যাংক, দিলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আরোপ।

ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) বা অন্য কোনো আমানতের সুদের টাকায় সংসারের বড় অংশ খরচ করেন অনেক মধ্যবিত্ত। সুদের টাকা বেশি পেলে তাঁদের স্বস্তি দেয়। অর্থমন্ত্রী এবার সেই স্বস্তির জায়গায় শর্ত দিলেন। এখন সুদের টাকা উত্তোলন করার সময় টিআইএন দেখালে ১০ শতাংশ এবং টিআইএন দেখাতে না পারলে ১৫ শতাংশ কর কেটে রাখা হয়। এবার থেকে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র না দেখাতে পারলে ১৫ শতাংশ হারেই উৎসে কর কেটে রাখা হবে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা দুঃসময়ের জন্য সঞ্চয় করেন। অনেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা সংসার চালাতে খরচ করেন। তাঁদের বেশির ভাগের করযোগ্য আয় নেই। কিন্তু এই শ্রেণিতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) খুললেই হবে না, বছর শেষে রিটার্ন দিতে হবে। কারণ, রিটার্ন জমা ছাড়া তাঁরা পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশাপাশি তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে এখন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। এত দিন ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে শুধু টিআইএন নম্বর থাকলেই হতো। এ বছর রিটার্ন জমাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সংসারের খরচ জোগান দিতে এখন অনেক গৃহিণী ওয়েবসাইট খুলে কিংবা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহার করে অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কেউ পোশাক-আশাক বিক্রি করেন, কেউ গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি করেন। তাঁদের ব্যবসা করা আরও কঠিন হলো। তাঁদেরও এখন থেকে টিআইএন খুলে রিটার্ন দিতে হবে।

Link copied!