মিডিয়া ভব্যতা: নুহাশ যে কারণে সঠিক অবস্থানে আছেন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ১৯, ২০২২, ১২:৩৭ এএম

মিডিয়া ভব্যতা: নুহাশ যে কারণে সঠিক অবস্থানে আছেন

বহু ঘটনা প্রতিদিন ঘটে যায়, ঘটে চলে। সেসব ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে মূহুর্তে ছড়িয়েও পড়ে। কিছু বিষয় ভাইরালও হয়। কিন্তু ভাইরাল হওয়ার পরও অনেক বিষয়ে আমি প্রতিক্রিয়া দেখাই না। নিজে মিডিয়ার একজন মনোযোগী পাঠক এবং একজন মিডিয়াকর্মী হওয়ার পরও আমি চুপ করে থাকি। এর মানে এই না, যে প্রতিক্রিয়া দেখালে কেউ এসে আমাকে খেয়ে ফেলবে বা কারও হামলার ভয়ে ভীত আমি। মূলত ভয়ডর আমার কোনোকালে ছিল না, মিডিয়াকর্মী হওয়ার পরও নেই।

চুপ করে থাকি এ কারণে যে, যে অনৈতিক উদ্দেশ্যে মিডিয়া তার কনটেন্টটি বাজারে ছেড়েছে, সবাইকে উস্কে দেওয়ার জন্য, দুটো লাইক-কমেন্ট-শেয়ার লাভের জন্য, দু পয়সা আয়ের জন্য; সেই উদ্দেশ্যটিকে আমি সফল হতে দিতে চাই না। যদিও আমার এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ মহাসাগরে একটি প্রস্তরকণা দিয়ে ঢিল ছুড়বার মতোই! এ যুগে যেখানে হুজুগে মাতবার ট্রেন্ড চলে, আর আমরা ত ঐতিহ্যগতভাবেই হুজুগে জাতি। ফলে জানিই সফল হবো না। তারপরও আমি একাকি হয়েও এরকম কনটেন্টের প্রতি এই নিস্ক্রিয়তা দিয়ে একটি বার্তা দিতে চাই যে, ওহে মিডিয়া, তোমার চাতুরি আমি ধরতে পেরেছি। তোমার ওই চাতুরতায় আমি মজব না।

এভাবে ওই উদ্দেশ্যমূলক কন্টেনটির প্রতি আমার নিস্ক্রিয়তার ধারা জারি রাখি। এতে আমার দুটি উদ্দেশ্য সাধন হয়: এক. গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো থেকে বিরত থাকার আত্মতৃপ্তি। দুই. কেউ যদি আমাকে অনুসরণ করেন, তিনি অন্তত আমাকে দেখে ভুলটা করলেন না।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যখন মারা গেলেন, তখন দেশ যথারীতি এবং বরাবরের মতো দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। গুলতেকিন বনাম শাওন। দুই দলে মার মার কাট কাট এক অবস্থা! সেই সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন অথচ কোনো পক্ষ নেননি, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। আমি সে সময়ও নিরব ছিলাম। একটি কথাও লিখিনি, না ফেসবুক পোস্টে, না কোনো কলামে। সাংবাদিকদের সাথে আড্ডাতে এ প্রসঙ্গে দু-চারবার কথাটি উঠেছিল বটে, তখন অবশ্য আমি কিছু কথা বলেছি ঠিক এভাবে: হুমায়ূন, গুলতেকিন কিংবা শাওনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে পারি না। আমরা জানি না যে একটি ছাদের নিচে একটি দম্পতি কেমন জীবনযাপন করে থাকেন। সেই জীবনে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। কেউ যদি তা করতে চান, সেটি হবে বড় অভব্যতা-অসভ্যতা। ঘরের জীবনটি একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব। বাইরের মানুষের সে বিষয়ে কথা বলা অযাচিত। সে কারণে আমি ওই হুমায়ূন আহমেদ ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করিনি। আলোচনার বিষয় যদি লেখক-সাহিত্যিক-নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ হতেন, আমি হয়তো তখন কথা বলতাম। এখনও কথা বলতে রাজি।

এ রকম আরও বহু সেলিব্রেটির ব্যক্তিগত ইস্যু এ দেশে এসেছে এবং গেছে, আসবে। আমি এসব বিষয়ে নিরব থাকার ব্রত নিয়েছি। কিন্তু মিডিয়া বিষয়ক কোনো কিছু আলোচনায় এলে, আমি তখন কিছু বলবার বা লিখবার তাড়না বোধ করি। এই যেমন, নবীণ চলচ্চিত্রকার নুহাশ হুমায়ূনকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে দুইভাগে বিভক্ত হতে দেখলাম। ঘটনার শুরু, একটি মিডিয়ায় তাঁকে প্রশ্নের নামে হেনস্তা করার চর্চা। তুমুল আলোচনার কারণে কথিত সেই সাক্ষাৎকারটি আমি দেখতে বাধ্যও হলাম। যেহেতু আলোচনার বিষয় মিডিয়ার ভব্যতা, ফলে আমাকে সেই ইন্টারভ্যুটি বার কয়েক দেখতেও হল। দেখে যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই হল। গোটা ইন্টারভ্যু জুড়ে প্রশ্নকারী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নুহাশ নয়, নুহাশের বাবার দিকেই ফোকাস করবার একটি তোড়জোড় করেছেন। এ বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে বলে নিই, এই যে আমাকে কয়েকবার দেখতে হল ইন্টারভ্যুটি, এখানেই সফল ওই অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানের প্রশ্নকারী, অনুষ্ঠানের প্রযোজক-আয়োজক এবং সর্বোপরি মিডিয়াটি।

ওই ইন্টারভ্যুটি ভাইরাল হওয়ার পরই কিছু লিখবার মনস্থির করেছিলাম। লিখতে লিখতে দেরি হয়ে গেল যদিও।

মিডিয়াটি ঠাণ্ডা মাথায় এই বিতর্ক উস্কে দেওয়ার পর ওই ভিডিওর ভিউ বেড়ে গেছে বহু গুনে। পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক চলেছে সমানে। একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, পেশায় যাঁরা সাংবাদিক তাঁদেরও বেশিরভাগ নুহাশকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে বের হতে পারেননি। বিবেচনাবোধ তাঁদের কাছে পরাহত হয়েছে। অথচ সাংবাদিক সমাজ একবারও বললেন না যে, একজন চলচ্চিত্রকারকে তাঁর কোন এক অর্জনের জন্য সাক্ষাৎকার নেবার সময়ে বাবার পরিচয়েই তার অর্জনকে ব্রাকেটবন্দি করার প্রয়াসে যে প্রশ্নগুলো করা হল সেটা পরিস্কার অভদ্রতা! শুধু একবার নয়, পরপর তিন-চারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই একই পয়েন্টে রাখা হল প্রশ্নটি!

মোটের ওপর মিডিয়াটি এবং তাদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটিও সাফল্য পেয়েছে। তবে নৈতিকতার বিচারে তারা কি সফল হয়েছেন? সাক্ষাৎগ্রহীতা এবং ওই অনুষ্ঠানের পেছনে যাঁরা আছেন তাঁরা কি নৈতিকতার মানদণ্ডে উৎরে যেতে পেরেছেন? তারা যে সফল হতে পারেননি তার একটি বড় প্রমাণ এ নিয়ে নুহাশ হুমায়ূন নিজে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে সমালোচনা করে পরিষ্কার কিছু পোস্ট দিয়েছেন।

নুহাশ যেমনটা সেই মিডিয়া ও অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, “তোমাদের কী মনে হয় সানডেন্স, বুসান, এসএক্সএসডব্লিউ, মার্শে দ্যু ফিল্ম বাপের নাম দেখে প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানায়?”

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও লিখেছেন, “বাংলাদেশে সাংবাদিকতা যদি আরেকটু সম্মানজনক হত! একটু আগে প্রথম আলোর লাইভ ইন্টারভিউতে ছিলাম; ভেবেছিলাম সেখানে ষ (ওয়েব সিরিজ) নিয়ে কথা হবে। সেখানে আমাকে প্রশ্ন করা হল, হুমায়ূন আহমেদ আমার বাবা না হলে আমি এখানে আসতে পারতাম? আমি জানি না, আপনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে এরকম প্রশ্ন কীভাবে করেন।”

শুধু নুহাশই নন, বিতর্ক থেকে সব সময় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা তাঁর মা গুলতেকিন খানও সরব হয়েছেন এ নিয়ে। তিনি ফেসবুক পোস্টে ছেলেকে প্রবোধ দিয়ে লিখেছেন, “আপসেট হয়ো না বাবা। এ কারণেই আমি কোনো পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিই না। তারা নানাভাবে চেষ্টা করে; আমি বলি, প্রশ্ন মেইলে পাঠাও। আমি দেখলাম, কয়েকটা প্রশ্নের পর আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে। কেউ কেউ উত্তরের এক অংশ ধরে ভিডিও বানায়, নানা অসত্য তথ্য থাকে। এটাই কী পেশাদারিত্ব?”

তাঁর বোন নোভা আহমেদ ‘এমন সংবাদকর্মীদের’ কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন নুহাশকে।

বিতর্ক ছুঁয়ে গেছে জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপি করিমকেও। তিনি নুহাশকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “খুবই টিপিক্যাল প্রশ্ন করেছে। এই ধরনের সাক্ষাৎকারগুলো এড়িয়ে চলো। বিশেষ করে কথিত, অর্থহীন লাইভ ইন্টারভিউগুলো।”

এ রকম আরও অনেকে লিখেছেন নুহাশকে উদ্দেশ্য করে, তাঁর অবস্থানকে সমর্থন করে।

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে নুহাশকে ওরকম প্রশ্নের জন্য প্রথম প্রতিবাদটি করতেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। তিনি তখন উপস্থাপকের উদ্দেশ্যে বলতেন, একজন সাংবাদিক বা উপস্থাপককে অবশ্যই জানতে হবে, 'আপনার চলচ্চিত্র জীবনে বা চলচ্চিত্রে আসার পেছনে আপনার বাবার কোন প্রভাব আছে কি না' আর 'আপনার বাবা না থাকলে আজকের এই জায়গায় আসতে পারতেন কি না' জাতীয় প্রশ্নের ফারাক কতটুকু।

সাংবাদিকতা গতিশীল একটি বিষয়। গতকাল যে ধারা ছিল, আজ সেটি নেই। আগামিকাল সেটি আরও বদলে যাবে। তেমনি সাংবাদিকতায় সাক্ষাৎকার একটি দারুন উপভোগ্য বিষয়। এটি গ্রহণের ধারাও নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই বলে এর যে চিরকালীণ নীতি-নৈতিকতা আছে, সেটি বর্জনীয় নয় মোটেও। সেই বেসিক গ্রামার মেনেই সাক্ষাৎকার নিতে হয়। সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিত্ব ও মেজাজ— এ দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি আদর্শ সাক্ষাৎকারে সাক্ষাৎগ্রহণকারীর অতি আগ্রাসী (ওভার অ্যাগ্রেসিভ) বা অতি কৌশলী হওয়া অনুচিত। আবার অতি বিনয়ী বা কৌশলহীন (ওভার সোশিয়েবল) হওয়াও সঠিক নয়। নুহাশের সাক্ষাৎগ্রহিতা এ দুটি বিষয়িই বেমালুম ভুলে গেছেন বা তাঁকে দিয়ে ওই অভব্য বিতর্কিত প্রশ্নটি করানো হয়েছে।

শুনেছি, এখন মিডিয়া বিতর্ক তৈরি করার জন্য ট্রিকস খাটায়। এতে নাকি তারা আলোচিত হয়, এবং প্রচার ও প্রসার লাভে সফলও হয়। অনৈতিক এই পন্থাটি ‘সফল’ হবার নাকি একটি সস্তা ফর্মুলা। বিতর্ক উস্কে দিয়ে লাভের লাভ হয় মিডিয়ারই। আলোচ্য ইন্টারভ্যুটি সেই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে কিনা, আমরা জানি না। তবে এটি বলা যায়, গণমাধ্যমের একটি কাজ যদি হয় ’শেখানো’, তাহলে তারা কী শেখাচ্ছে পাঠকসমাজকে? প্রশ্নটি উঠে আসে।

মিডিয়া শুধু আদর্শের প্রচার করে না, সে নিজেও একটি আদর্শের  বড় দৃষ্টান্ত। সে সমাজকে শেখায়। সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে যখন মিডিয়া শুধু রেভিনিউয়ের দিকে ঝোঁকে, তখন তার সাথে বাজারের ক্যানভাসারের আর কোনো পার্থক্য থাকে না। ক্যানভাসারের উদ্দেশ্য শুধুই প্রফিট। তার ওষুধে উপকার হল কি হল না, সেটি খুবই গৌণ তার কাছে। কিন্তু মিডিয়ার উদ্দেশ্য শুধু প্রফিট করা নয়, ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের যে সুবিশাল অডিয়েন্স আছে, তাদের উপকার হল কিনা, সেটিও নিশ্চিত করা। তথ্যবিক্রি নয় শুধু, তথ্যসেবাও নিশ্চিত করা। সমাজকে একটি আদর্শের দিকে চালিত করা।

এসব কারণেই কিন্তু সাংবাদিকতার ক্লাসে এথিকসও খুব গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়। এই এথিকস যে কি জরুরি, আমরা এ দেশের সাংবাদিকতায় বারবার টের পাই। আমরা এমনও দেখি, কথিত সেলিব্রেটি সাংবাদিক আমাদের ক্রিকেটারদের নাম ধরে এবং ‘তুমি’ করে সম্বোধন করে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন! ক্রিকেটার বারবার অস্বস্তি প্রকাশ করে অগত্যা ইন্টারভ্যুর মাঝেই কথা বলা বন্ধ করে হাঁটা দিয়েছেন!

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

 

Link copied!