রাজা চার্লসের অভিষেকের সময়ই ক্যামিলার মাথায় উঠছে কোহিনুর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২, ০৩:৪৯ পিএম

রাজা চার্লসের অভিষেকের সময়ই ক্যামিলার মাথায় উঠছে কোহিনুর

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর আজ আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা হচ্ছেন তৃতীয় চার্লস। গত  বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানির মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছে কোহিনুর হিরে নিয়েও। এত বছর ধরে রানির মুকুটে শোভা পেত কোহিনুর। এখন তা শোভা পাবে কোথায়?

চলতি বছরের শুরুতেই রানি এলিজাবেথ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর অবর্তমানে ‘কুইন কনসর্ট’ হবেন যুবরাজ চার্লসের স্ত্রী, ডাচেস অব কর্নওয়াল ক্যামিলা। শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) চার্লসের রাজা হিসাবে অভিষেকের সময় ক্যামিলার মাথায় উঠবে সেই কোহিনুর বসানো মুকুট।

বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী কোহিনুর

শতকের পর শতক পার হতে হতে কোহিনুর সাক্ষী থেকেছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার। বহু ঐতিহাসিক যুদ্ধকে চাক্ষুষ করেছে এই মূল্যবান হিরে। দেখেছে দরবারের জটিল কূটনীতি, সিংহাসন বদলও। এই কোহিনুরকে ঘিরে রয়েছে বহু বিতর্ক, চলেছে মামলাও।

১০৫.৬ মেট্রিক ক্যারাটের এই হিরের ওজন ২১.৬ গ্রাম। ১১০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরের কাছে কল্লুর খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিল এই হিরে। ১৩১০ সালে কাকোতীয় বংশের সঙ্গে বরঙ্গলের যুদ্ধে এই হিরে দখল করেন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি।

পরে তা হাতবদল হয়ে আসে মুঘল দরবারে। 'বাবরনামা'য় উল্লেখ রয়েছে, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে তা বাবরের দখলে আসে।

সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে ময়ূর সিংহাসনে শোভা পেত কোহিনুর। পার্সি ভাষায় ‘কোহিনুর’ শব্দের অর্থ 'আলোর পর্বত' (মাউন্টেন অব লাইট)।

১৭৩২ সালে নাদির শাহ মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ ও দিল্লি লুণ্ঠন করে ময়ূর সিংহাসনের সঙ্গে কোহিনুর হিরেটিকেও নিয়ে যান ইরানে। পরে দেহরক্ষীদের দ্বারা নিহত হন নাদির শাহ

নাদির শাহের পর আহমদ শাহ দুররানি কোহিনুর হস্তগত করেন। কিন্তু কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, নাদির শাহের নাতি নিজেই দুররানিকে এই হিরেটি উপহার দিয়েছিলেন।

১৮১৩ সালে দু্ররানি পঞ্জাবের সিংহাসন হারলে তা ‘শের-ই-পঞ্জাব’ মহারাজা রঞ্জিত সিংহের হাতে আসে। তিনি নাকি এই বহুমূল্য হিরে তাঁর পাগড়িতে আটকে রাখতেন।

রঞ্জিত সিংহের পর এই হিরের মালিকানা লাভ করেন নাবালক মহারাজা দলীপ সিংহ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পঞ্জাবে তাদের ঘাঁটি গড়লে শুরু হয় কোহিনুরের পরবর্তী অধ্যায়।

১৮৪৯ সালে লর্ড ডালহৌসি ও মহারাজ দলীপ সিংহের মধ্যে লাহৌর চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির শর্তানুসারে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে কোহিনুর হিরে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন লাহৌরের মহারাজ।

তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত এক মামলায় (আরটিআই) একটি প্রশ্নের জবাবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই)-র তরফে এ কথা জানানো হয়েছে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে উপঢৌকন হিসেবে কোহিনুর দেননি লাহৌরের মহারাজা রঞ্জিত সিংহের উত্তরাধিকারীরা।

সেই কুখ্যাত লাহৌর চুক্তির তিন নম্বর অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘শাহ সুজা-উল-মুলকের কাছ থেকে রঞ্জিৎ সিংহ যে কোহিনুর হিরে নিয়েছিলেন, সেই হিরে ইংল্যান্ডের মহারানিকে দেবেন দলীপ সিংহ।

শোনা যায়, এই হিরে কেড়ে নেওয়া নিয়ে বিবেক দংশনে ভুগতেন রানি ভিক্টোরিয়া। ইংল্যান্ডে পৌঁছনোর পরেও কোহিনুর হিরে তখনও ইংল্যান্ডের রাজমুকুটে জায়গা পায়নি।

শোনা যায়, ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্রাসাদে দলীপ সিংহের কাছ থেকে ব্যক্তিগত অনুরোধের মাধ্যমে এই কোহিনুর হিরে ফের উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।

বিষয়টি যে আদ্যন্ত সাজানো ঘটনা ছিল, সে কথা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরাও। এর পরেই নিজের রাজমুকুটে কোহিনুর বসিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।

কোহিনুর ফিরে পেতে পাকিস্তান-ভারতের আইনী চেষ্টা

পরবর্তী কালে এই হিরে দেশে ফেরানোর অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ২০১৯ সালে পাকিস্তানও এই হিরে ফেরত চেয়ে নিজেদের দাবির কথা জানিয়েছিল ইংল্যান্ডের কাছে।

পাকিস্তানের যুক্তি, লাহৌর ছিল শিখ সাম্রাজ্যের রাজধানী। লাহৌর চুক্তির মাধ্যমেই কোহিনুর নিজেদের হেফাজতে নেয় ইংল্যান্ড। তাই এই হিরে ফেরত আসবে লাহৌরেই। লাহৌর জাদুঘরে ঠাঁই পাবে কোহিনুর— এমনটাই জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরি

ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া বিশ্ববিখ্যাত কোহিনুর ইংল্যান্ডের কাছ থেকে চাওয়া সম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা খারিজও করে দেয় দেশের শীর্ষ আদালত। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জানিয়েছে, ‘ইংল্যান্ডের কাছ থেকে এই হিরে ফেরত চাওয়ার দাবির পিছনে কোনও আইনগত যুক্তি নেই।’

১৯৩৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেকের সময় প্ল্যাটিনামের মুকুটে বসানো হয়েছিল কোহিনুর। সেই মুকুট পরেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথের মা ‘কুইন মাদার’ এলিজাবেথ।

তার পরে তা রানি এলিজাবেথের কাছে আসে। টাওয়ার অব লন্ডনে রাখা থাকে সেই মুকুট। এখন সেই কোহিনুর শোভা পাবে চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলার মুকুটে। সূত্র: আনন্দবাজার

Link copied!