আজ শুভ দোল পূর্ণিমা। এর আরেক নাম বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়। রঙের উৎসব দোল পূর্ণিমা। এই উৎসবে মেতেছে গোটা ভারতবাসী। দেশজুড়ে এইদিনটি আবিরের রঙে উদযাপন করা হয়। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও নেপালের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও যথাযত মর্যাদায় পালন করছেন দিনটি।
প্রতি বছর বাঙালী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিতে রঙ খেলায় আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। দোলযাত্রা যেন বসন্তের আহ্বান। এই উৎসবটি যেন জানিয়ে দেয় শীত বিদায় নিয়েছে, এসেছে বসন্তের ছোঁয়া। এই দিনটিতে বাঙালিরা একে অপরকে রঙে রাঙিয়ে দেয়। এই দিনে বাতাসে যেন একটাই সুর বয়ে চলে “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে”। এই বসন্ত উৎসবকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি যেন এক বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীর সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এর পর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রঙ খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন প্রকার রঙ নিয়ে খেলায় মত্ত হয়। দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত।
দোলের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। সেইসব কাহিনি, আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও উত্সবরে মেজাজের মোড়কে বর্তমান চেহারা পেয়েছে দোল। পৌরাণিক ইতিহাসকে স্মরণে রেখে আজও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে রীতি মেনেই পালন করা হয় হোলি। দোল পূর্ণিমাকে বেশ কয়েকটি ছোট কাহিনী রয়েছে পূরানে।
প্রথম কাহিনী:
ধুন্ধি- রঘু বংশের পৃথু রাজার রাজত্বে ধুন্ধি বলে এক রাক্ষসী ছিল। ছোট ছোট শিশুদের দেখলেই ধরে খেয়ে ফেলত ধুন্ধি। মহাদেবের কাছ থেকে বরপ্রাপ্ত ধুন্ধি জানত, তাকে মারার ক্ষমতা কোনও দেবতার, মানুষের, অস্ত্রের এমনকী প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও নেই। তবে কিছু উন্মত্ত বালকের হাতে তার প্রাণশঙ্কা রয়েছে। ধুন্ধির উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজা পৃথু তাঁর পুরোহিতের কাছে পরামর্শ চান।
রাজ পুরোহিত বলেন, ফাল্গুন মাসের পুর্নিমায় যখন পৃথিবী থেকে শীত চলে গিয়ে বসন্তের আবির্ভাব হয়, সেই ক্ষণে কিছু বালক যদি কাঠ ও ঘাসের স্তুপে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ঘুরে নেচে, গেয়ে, তালি বাজিয়ে মন্ত্র পাঠ করে, তবে ধুন্ধির মৃত্যু হবে। সেই থেকেই দোল পুর্নিমার আগের সন্ধ্যায় এই রীতির চল হয়।
উত্তর ভারতে এর নাম হোলিকা। বাংলায় দোলের আগের দিন ন্যাড়াপোড়ার মাধ্যমে এই যজ্ঞ করা হয়। অশুভ শক্তির হাত থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার উৎসব হোলিকা। অন্যদিকে জীর্ণ শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের আগমনকে স্বাগত জানায় হোলিকা দহন।
দ্বিতীয় কাহিনী: কামদেব-দক্ষ রাজা কতৃক শিবের অপমান সহ্য করতে না পেরে আগুনে ঝাঁপে দেন সতী। স্ত্রীর দুঃখে কাতর শিব পৃথিবী ভুলে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। এই সময়ই হিমালয় কন্যা পার্ব্বতীও শিবকে কামনা করে ধ্যানে বসেন। শিবের এহেন আচরণে দেবতারা শঙ্কিত হয়ে কামদেবের দ্বারস্থ হন। কামদেব ধ্যানমগ্ন শিবকে লক্ষ্য করে তাঁর শর ছোঁড়েন। কামদেবের আচরণে শিব ক্ষিপ্র হয়ে ওঠেন ও তৃতীয় চক্ষু উন্মীলিত করে তাঁকে ভস্ম করে দেন। তবে কামদেবের শরের প্রভাবে পার্ব্বতীকে বিবাহ করেন শিব। পরে কামদেবের স্ত্রী রতির অনুরোধে তাঁকে পুররুজ্জীবন দান করেন শিব।
পুরাণ মতে দোল পুর্নিমার দিনই কামদেবকে ভস্মে পরিণত করেছিলেন শিব। দক্ষিণ ভারতে এই দিন কামদেবের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালন করা হয় হোলি। আম পাতা ও চন্দন বাটা দিয়ে কামদেবের দহন জ্বালা উপশম করা হয়। রতির দুঃখে গানও গাওয়া হয়। তামিল নাড়ুতে কামবিলাস, কামান পাড়িগাই ও কাম দহনম এই তিন নামে আরাধনা করা হয় কামদেবের।
তৃতীয় গল্প: পুরানে আছে পূতনা-শিশু কৃষ্ণকে বধ করতে রাক্ষসী পূতনার দ্বারস্থ হয়েছিলেন রাজা কংস। সুন্দরী রমনীর ছদ্মবেশে কৃষ্ণকে তাঁর বিষাক্ত স্তন্যপান করায় পূতনা। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁর রক্তপান করে ও শেষপর্যন্ত পূতনার মৃত্যু হয়। হোলির আগের দিন রাত্রে কাঠ ও ঘাসের স্তুপ জ্বালানোর মাধ্যমে পূতনা বধের আয়োজন করা হয়। অশুভ শক্তির বিনাশ করাই এর লক্ষ্য। অপরদিকে শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের আগমন।
চতুর্থ কাহিনী:
হোলিকা- সারা পৃথিবীতে একাধিপত্য স্থাপন করেন রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপু। তাঁর দাবি ছিল পৃথিবীর সকলকেই শুধমাত্র হিরণ্যরশিপুর উপাসনা করতে হবে। কিন্তু তাঁর নিজের পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রহ্লাদ বহুবার হত্যা করার চেষ্টা করেও বিষ্ণর আশীর্বাদে ব্যর্থ হব হিরণ্যকশিপু। শেষ পর্যন্ত তাঁর বোন হোলিকাকে হিরণ্যকশিপু অনুরোধ করেন শিশু প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করতে। হিরণ্যকশিপু জানতেন বরপ্রাপ্ত হোলিকা আগুনে প্রবেশ করতে পারেন। হিরণ্যকশিপুর আদেশ পালন করেন হোলিকা। কিন্তু হোলিকা জানত না বর তখনই কার্যকর হবে যদি সে একা আগুনে প্রবেশ করে। অন্যথায় তার মৃত্যু হবে। ক্রমাগত বিষ্ণ নাম জপ করে রক্ষা পায় শিশু প্রহ্লাদ। সেই থেকেই উত্তর ভারতে দোল পুর্নিমার আগের দিন পালিত হয় হোলিকা দহন উত্সব।
হোলি নামেরও উত্পত্তি হোলিকা শব্দ থেকেই। হোলিকা দহনের আগুন থেকে একমুঠো ছাই তুলে নিয়ে ঘরে রাখার রেওয়াজও প্রচলিত রয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। বিশ্বাস, এই ছাই ঘরে থাকলে রোগমুক্তি ঘটবে।
পঞ্চম কাহিনী:
রাধা-কৃষ্ণ- কাল মেঘের মত গায়ের রং। তাই দুঃখের অন্ত ছিল না বালক কৃষ্ণর। এদিকে রাধার দুধে আলতা রং দেখে ঈর্ষাও জাগে মনে। মা যশোদাকে দুঃখের কথা জানালে যশোদা কৃষ্ণকে বলেন তাঁর মনের মত রঙে রাধাকে রাঙিয়ে দিতে। দুষ্টু কৃষ্ণ ফাঁক বুঝে রং ঢেলে দেয় রাধার মুখে। সেই থেকেই শুরু হয় দোল খেলার রীতি। কৃষ্ণ রাধা ও গোপিদের গায়ে লুকিয়ে দূর থেকে রং দিয়েছিল। পিচকারির প্রচলনও সেই থেকেই। মথুরা, বৃন্দাবন, বরসন, নন্দগাঁওতে এখনও এই ভাবেই উদযাপন করা হয় হোলি। অনেক জায়গায় রাধা-কৃষ্ণর মূর্তি নিয়ে পালকিও বের হয়।