জানুয়ারি ২৮, ২০২২, ০৮:১১ পিএম
হঠাৎ করে চলে যাওয়া সাংবাদিক হাবীব রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় পূর্নাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে তার বন্ধু-শিক্ষক-সহযোদ্ধারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক স্মরণসভায় এই দাবি ওঠে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে হাবীবের বন্ধুদের আয়োজনে এই স্মরণসভা হয়। স্মরণসভায় তার বিভাগ-হল-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু-শিক্ষক-সাংবাদিকতার সহকর্মী, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন।
প্রিয়জনদের কষ্টটাও বেশি
হাবীবের বন্ধু আলী আসিফ শাওন বলেন, হাবীবকে নিয়ে বলতে গেলে কয়েকদিন ধরে বলতে পারবো। পরিবারের বাইরে যার সাথে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকতো, সেটা হল হাবীব। মৃত্যু যে এভাবে মানুষকে কেড়ে নিয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। আমারও দাবি, হাতিরঝিলের ঘটনার তদন্ত চাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাতে চাই, এই ঘটনার তদন্ত হোক।
হাবীবের বন্ধু শাকিল হাসান বলেন, এই অনুষ্ঠানের আগে মনে হচ্ছিল, এই তো হাবীব চলে এসে বলবে, কী করছিস! কীসের আয়োজন! যেন এখন এসে বলবে, এটা কীসের আয়োজন। হয়ত আমাদের আয়োজন নিয়ে প্রশ্নও তুলবে। ও এ রকমই ছিল। আমাদের মাঝে অনেক কিছুর আয়োজন ওই করতো।
ফারাবি হাফিজ বলেন, আমার চোখে ভাসে কেবল ওর হাসি মুখ। আমরা দাঁড়াতে শিখেছি, হাঁটতে শিখেছি, আমরা এখন দৌঁড়াবো। আর সে চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে! তার সাথে যত স্মৃতি সবই মানুষের উপকারের জন্য। যেমন, দোস্ত ছোট ভাইয়ের চাকরি লাগবে, কাউকে হলে তুলতে হবে--এ রকম নানা ইস্যুতে কথা হয়েছে। সবার উপকারের জন্যই সে সদা ব্যস্ত থাকত। তার দুর্ঘটনার পেছনে কোন রহস্য আছে কি—না, খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি।
এনটিভির সাংবাদিক মিজান রহমান বলেন, আমার ডাক নামে ডাকার মানুষ আর এই শহরে বেশি নাই। তিনি আমার ছোট। কিন্তু আমাদেরকেও অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। তার কমিউনিটি ফিলিংস, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়ে আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সচিব সাখাওয়াত মুন বলেন, জাদুকরি মুখ স্মরণ করছি। বসে বসে তার ছেলেটিকে দেখছিলাম। ও এখনও বুঝতেই পারছে না, ও কী হারিয়ে ফেলেছে। আমি মধ্যবয়সে এসে বাবাকে হারিয়েছি। সেটিই এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা হাবীবের পরিবারের পাশে থাকবো, তার সন্তানের পাশে থাকবো। যোগ করেন সাখাওয়াত মুন।
শিক্ষকরাও প্রশংসা করলেন
গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, আমি হাবীবকে ক্লাস রুমে পেয়েছি। ও বরাবরই বিনয়ী স্বভাবের ছিল। তার হাসিমাখা মুখ সবাইকে মুগ্ধ করতো। বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে হাবীবকে অন্য শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি আমি।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, হাবীব কেন, আমার কোন শিক্ষার্থীর স্মরণসভায় আসতে হবে, সেটা আমি ভাবিনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চাইতেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বন্ধুত্বের সম্পর্কে আমরা বেড়ে উঠেছি। ওদের সাথে অনেক কাজ করেছি। ওরা যোগাযোগ ইশকুল করেছে। সর্বশেষ এক দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সেদিন আমাকে একা একা রাতে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছিল হাবীব। তখন আমি বলেছি, তোমরা থাকতে আমার ভয় কী? যারা আমাকে অভয় দেয়, তাদের একজন চলে গেল।
কাবেরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু হলেও সেটা কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। হাবীবের বন্ধুরা যদি কোন উদ্যোগ নেয়, তোমরা যদি কোন উদ্যোগ নাও, বন্ধুর মতো আমরাও আমাকে তোমাদের সাথে রেখো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন, শোকসভায় বক্তৃতা করা। সেটা যদি শিক্ষার্থীর হয়, তাহলে আরো কঠিন। তার সাথে যোগাযোগটা সব সময়ই ছিল। তার খবরটি দেখে আমার বিশ্বাস হয়নি। অনেকে এটা দুর্ঘটনা কি-না, সেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। অনেকে আবার দুর্ঘটনাও বলছে। যারা এটাকে দুর্ঘটনা বলছে, এই কনক্লুশনে কীভাবে এত তাড়াতাড়ি গেছে। আমি চাই, একটা সুষ্ঠু তদন্ত হোক। তদন্তের ফল বের হোক। হত্যাকাণ্ডের কারণ বেরিয়ে আসলে আমরা শান্তি পাবো। তিনি জানান, যতদূর জানি, তদন্ত শুরু হয়েছে।
এখনও শোকাহত পরিবার
হাবীবের বাবা মো. পেয়ারা বলেন, আমি বাবা হয়ে ছেলের লাশ কাঁধে নিয়েছি। যে এটা নিয়েছে, তার মত দুঃখী আর কেউ নাই। আমি বড়ই আশা করে ছেলেকে লালন পালন করেছিলাম। আমার পর সে পরিবারকে দেখাশোনা করবে। অসুস্থ হলে আমার চিকিৎসা করবে, মরে গেলে আমাকে দাফন করবে। কিন্তু আমার সব শেষ হয়ে গেল।
হাবীবের স্ত্রী হাসি আক্তার রিমি বলেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, ওর সাদাকালো ছবি এভাবে থাকবে, আর আমি ওর জন্য কথা বলবো। আমার সব ছিল হাবীব। আমার সংসার, আমার ভালোবাসা। আর হাবীবের সব ছিলেন আপনারা। এটাই ওর ভালোবাসা ছিল৷ ও যা ভালোবাসতো, আমিও তা ভালোবাসতাম। আমি কাজের জন্য বিরক্ত হই নাই। ওর জন্য স্পেস করে দিতাম। আমি চাই, কারো সঙ্গেই এমনটা না ঘটুক। সবাই একটা সার্টেন এজে যাক, এই সময়ে চলে না যাক।
এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, ও নাই। সময়ের সাথে সাথে মানুষ অনেক ভুলে যায়। তবে আমি চাই, তাকে দোয়াতে ইয়াদ রাখবেন। ভুলে যাবেন না। আমাদের সাড়ে চার বছরের সংসার। সাড়ে চারশ বছর বেঁচে থাকার জন্য আমার সাড়ে চার বছরের স্মৃতি এনাফ। আমি এটা নিয়েই থাকতে চাই। আমার হাতে আমার সন্তান-মা-শ্বশুর-শাশুড়ির পাশে দাঁড়াতে চাই।
দুর্ঘটনা না অন্য কিছু তদন্তের দাবি
হাবীবের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমমেট শিক্ষা কর্মকর্তা শাহিন ইসলাম বলেন, এত সহজে মানুষের কাছে যেতে পারতো, সেটা অনেকেই পারতো না। এক রুমে দীর্ঘদিন ছিলাম। কখনোই কোন মান অভিমান হয়নি। হাবীবের কেবল মুখে আঘাত। আসলেই কি এটা দুর্ঘটনা? এটা যদি দুর্ঘটনা হয়, আমাদের কোন কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি হত্যাকাণ্ড হয়, তাহলে সেটার উদঘাটন হওয়া জরুরি।
হাবীবের বন্ধু সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমি পেশায় অপরাধ সাংবাদিকতা করি। প্রায়ই আমাকে মর্গে যেতে হয়। কিন্তু সেই মর্গে স্বজন নিয়ে কোনদিন মর্গে যাবো ভাবতে পারিনি। মর্গের সেখানে কাজ করা মানুষ আমাকে চেনে। তারা আমাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, এটাকে দুর্ঘটনা মানতে আমার পেশাগত অভিজ্ঞতা সায় দেয় না। এটা উদঘাটনের দাবি করছি।
উপস্থিত ছিল বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও
ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, বন্ধুদের মাঝে আড্ডা জমিয়ে রাখতো হাবীব। বন্ধুদের মাঝে কোন ঝামেলা হলে সেটা মিটমাট করতো সে। হাবীবের বাচ্চার পাশে থাকতে চাই। হাবীব যেন উপরে বসে কষ্ট না পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসাইন প্রিন্স বলেন, হাবীব ভাইয়ের মৃত্যু যদি কোন নাশকতা হয়, তাহলে সেই নাশকতাকারী যত শক্তিশালীই হোক, সেটাকে উপড়ে ফেলতে হবে।
ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, আপন করে নেয়ার সহজাত ক্ষমতা ছিল তার। শোকাবহ যে ঘটনা ঘটেছে, তার একটি পূর্ণ তদন্ত হোক। যাতে কোন আক্ষেপ নিয়ে আমাদেরকে থাকতে না হয়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাবীবের বন্ধু পুলিশ কর্মকর্তা তয়াসির জাহান বাবু বলেন, আমার যখন প্রচণ্ড মন খারাপ হতো, যার কাছে সেটা বলতাম, সেটা হাবীব। আনন্দের কথাও পরিবারের বাইরে যে কয়েকজনের সাথে বলতাম, সেটাও হাবীব। তার কথায় আস্থা পেতাম, ভরসাও পেতাম।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নাদিয়া শারমিন বলেন, হাবীবরা যখন ক্যাম্পাসে এসেছিল, তখন নীল শাড়ি পরে দল নিয়ে এখানেই কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম ওদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে। আজ নীল জামা পরে ওকে স্মরণ করতে এসেছি। আজ সামনের মানুষদের চোখে জল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মেহেদি হাসান বলেন, হাবীব ভাই একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আমরা দুর্ঘটনার পর ঢাকা মেডিক্যালে গেলাম। সেখানে নার্স আমাকে একটা কাগজে সাইন করতে বলে। আমি ভেবেছি, চিকিৎসার জন্য হয়ত সাইন লাগবে। চিকিৎসার পর তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, আড্ডা দেবেন। পরে দেখি, কাগজে ডেড লেখা।
“আমরা তার মৃত্যুর একটি ব্যাখ্যা চাই। আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটার একটা ব্যাখ্যা দেবেন।’’
যমুনা টিভির সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম, এই বড় ভাইয়েরা হাতে কলমে আমাদের কাজ শিখিয়েছেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, হাবীব ভাইয়ের মত এমন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক চলে গেছেন। পরিকল্পিত কোনভাবে হয়েছে, আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। যদি পরিকল্পিতভাবে তার খুন হয়ে থাকে, তাহলে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, এই প্রতিশ্রুতিশীল ছেলেটি আমার বন্ধু ছিল। আমি কোন স্মৃতিচারণ করতে চাই না। কারণ সে আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে। হাবীব যেভাবে নিহত হয়েছে, এ রকম ঘটনা চাই না। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে সড়ক দুর্ঘটনা মনে হয়েছে। কিন্তু আমরা এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত চাই।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতিব আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, আমরা ছাত্রলীগ পরিবার হাবীবের পাশে থাকবো। তিনি আরও বলেন, আমরা একটি ভিডিও দেখেছি। এটা দুর্ঘটনা হোক, আর যাই হোক, একটি পূর্নাঙ্গ তদন্ত হোক।
সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জিব চন্দ্র দাস, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ খান প্রমুখ।