সুনীলের নীরা’র সন্ধানে...!

মৃত্তিকা মৃন্ময়ী রহমান

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০২:১৫ এএম

সুনীলের নীরা’র সন্ধানে...!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় বারবার এসেছে নীরা নামের এক নারী। কে এই নীরা? যার জন্য ৭০ টি কবিতা লিখেছেন তিনি। নীরা কী আসলেই কোনো রক্তমাংসের মানুষ না কবি সুনীলের কল্পনার এক প্রেয়সীর নাম।

নীরার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো উত্তর দেন নি নিজের  প্রেম, যৌনজীবন, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে অকপটে অনেক কথা স্বীকার করে নেওয়া সুনীল।

নীরা কী কবির কোনো এক সময়ের প্রেমিকা? যাকে সুনীল ভুলতে পারেন নি গোটা জীবনে অথবা ভুলতে চান নি বলেই ফিরে দেখেছেন কবিতার ভুবনে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা’র সন্ধানেই আজকে আমাদের এই কন্টেন্ট...

২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বীথি চট্টোপাধ্যায়ের “লোহিত কণায় প্রেম” প্রবন্ধে সুনীলের জীবনে দাগ রেখে যাওয়া চারজন নারীর বিষয়ে জানা যায়।

কৈশোরে এক পাড়াতুতো দিদির প্রতি কবির আকর্ষণ জন্মেছিল। যদিও সেই দিদির প্রেমিকের তাচ্ছিল্য ও আস্ফালন কিশোর সুনীলকে গভীরভাবে ব্যাথিত করেছিল। সে প্রেম আর বেশিদূর আগায় নি।

এরপর দেশভাগের পর সদ্য যুবক সুনীলের সঙ্গে কোলকাতার বনেদী পরিবারের এক মেয়ের প্রেম হয়। আনন্দবাজারের প্রবন্ধে মেয়েটির নাম উল্লেখ না থাকলেও মঞ্জুভাষ মিত্র ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর সাহিত্য’ গ্রন্থে মেয়েটির নাম অপর্ণা ছিল বলে উল্লেখ করেন। বেকার জীবনের প্রেমে মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারেন নি সুনীল।

সুনীলের জীবনে এরপর আসে ফরাসী নারী মার্গারেট ম্যাথিউ। সুনীলের ফ্রান্স জীবনের স্মৃতিকথা নিয়ে লেখা ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ গ্রন্থে মার্গারিটার প্রসঙ্গে সুনীল নিজেই লিখেছেন। যদিও এই প্রেমও বৈবাহিক পরিণতি পায় নি।

তিনটি ব্যর্থ প্রেমের পর সুনীলের জীবনে আসেন স্বাতী বন্দোপাধ্যায়। প্রেম এবং বিয়ের পর সুনীলের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গে থেকেছেন স্বাতী।

বীথি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বাহাত্তর, পঁচাত্তর, আটাত্তরেও বিবাহ বর্হিভূত আপাত গোপন পেমিকার উত্তাপ, ঝঞ্চা, বিপত্তি তাঁর জীবনে এসেছে। সুনীল কখনো খোলাখুলি লেখেন নি সেসব কথা। সে সব প্রেমিকার কথা ঘর ভর্তি রঙিন মানুষের মধ্যে নীরবতা হয়েই আছে। মেঘের আড়ালে সূর্যের মতো শব্দের মধ্যে নৈশব্দ হয়ে রয়ে গেল সুনীলে জীবনের খানিকাংশ এবং তার পরিণত বয়েসের কয়েকজন প্রেমিকা।”

ভারতের প্রভু জগৎ বন্ধু কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুব্রত মÐলের “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা: বিচিত্র রূপে নারীকে দেখা” নিবন্ধ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, “তিনটি ব্যার্থ প্রেমের সুপ্ত পিপাসাই কী সুনীলের নীরাকে সৃষ্টি করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলবে আবহমান কাল নীরা ও তার স্রষ্টা সুনীলের চির নীরবতার মাঝে।”

সুনীলের নীরাকে বাস্তব নারীর দর্পণে না খুঁজে, সুনীলের প্রেমিক মানসের কাছে পৌছলেই নীরাকে অনেকটা খুজে পাওয়া যাবে বলেও মত দেন তিনি।

Sunil Gangopadhyay Birthday: 'এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি', সুনীলের নারী  কে এই নীরা?। Sunil Gangopadhyay Birthday: mystery still lasts relating neera  the famous muse of poet sunil Gangopadhyay

গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, নাটক, কাব্য নাটক, ভ্রমণ কাহিনি, আত্মজীবনী- সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই ঈর্ষণীয় সাফল্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। বিদগ্ধজনেরা হয়তো সুনীলকে স্মরণ করেন তাঁর বিখ্যাত ট্রিলজি; পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো আর সেই সময় এর মতো কালজয়ী লেখা দিয়ে। কিন্তু রোমান্টিক বাঙালির কাছে নীরাই প্রেমের শাশ্বত প্রতীক। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের মতো সুনীলের নীরাও এশটি কালোত্তীর্ণ রোমান্টিক নাম হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্যে।

নীরাকে নিয়ে সুনীলের লেখা প্রায় ৭০টি কবিতার উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থে। সুনীলের সবগুলো নিয়ে কলকাতার ‘আনন্দ’ প্রকাশনী পাঁচ খন্ডের একটি কবিতাসমগ্র প্রকাশ করেছে যার প্রতিটি খন্ডেই রয়েছে নীরার ছোঁয়া।

বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্নভাবে নীরাকে দেখতে পাই আমরা। যেমন এক কবিতায় সুনীল নীরাকে প্রশ্ন করেছেন-

“আমার যখন উনিশ,

তুমি কোথায় ছিলে,

নীরা?”

সুনীল নিজেই কবিতায় বলেছেন, তিনি যখন উনিশ বছরের তরুণ, তখনও নীরাকে চিনতেন না। আবার ‘শুধু তুমি নীরা’ গ্রন্থের ভূমিকায় নিজের বয়ানেই নীরার সম্পর্কে জানিয়েছেন- তখন তিনি তিরিশের কিছু কম বয়সী ছিলেন। ছোট চাকরি করতেন। একদিন সকাল  পৌনে দশটায় সার্কুলার রোডের এক বাসস্টপে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নীরার জন্য কয়েকটি পঙক্তি মাথায় ঝড় বইয়ে দেয়। ঘটনাটা স্বীকার করলেও তার কার্যকারণ কিন্তু স্বীকার করেননি তিনি। অর্থাৎ বাসস্টপে কাউকে দেখে তিনি সেই অনুভূতি পেয়েছেন কিনা সেটি জানান নি। আবার ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ কবিতায় তিনি বলেছেন—

বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল

                                   স্বপ্নে বহুক্ষণ

দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–

বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে

তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের

নীল দুঃসময়ে।

 

আবার ‘কথা' কবিতায় সুনীল নীরাকে বলেছেন—

“বৃষ্টির মধ্যে তুমি চৌরাস্তায় ট্যাক্সি খোঁজাখুঁজি করছিলে নীরা

আমি তখন চলন্ত ট্রামের জানালায়”

বাসস্টপে প্রথমবার নীরাকে নিয়ে কবিতার জন্ম। সেই থেকে শুরু। তারপর আমৃত্যু সুনীলের কবিতায় নীরা ফিরে এসেছে বারেবার। সুনীলের বয়স বাড়ে কিন্তু নীরা থেকে যায় নবীন-যৌবনা। তার মানে কি নীরা রক্ত মাংসের কোনো মানবী নয়? শুধুই কবির কল্পনা? জীবদ্দশায় অনেক সাক্ষাৎকারেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু কোথাও স্বীকার করেননি নীরা নামের কোনো নারীর অস্তিত্বের কথা। আবার উড়িয়েও দেননি অস্বীকার করে।

‘শুধু তুমি নীরা’ গ্রন্থের ভূমিকায় সুনীল লিখেছিলেন,

“তাকে আমি রক্তমাংসের মানবী করে রাখতে চাই তবু হঠাৎ হঠাৎ সে চলে যায় শিল্পের সীমানায়। যেন সে হয়ে ওঠে ভাস্কর্যের রমনী। যেন সে শুধু আমার নয়, জাদুঘরের শিল্পকীর্তির মতো সর্বসাধারণের। আমি তাকে আবার ফিরিয়ে আনি, তার পায়ে কাঁটা  ফোটে, তার চোখে টলমল করে অশ্রু। এই দূরত্ব এবং আলিঙ্গনের নৈকট্য, নীরার সঙ্গে এই খেলা চলছে সারাজীবন।’’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- নীরা কে?-সে সম্পর্কে। তিনি সহাস্যে জানিয়েছিলেন তিনি নীরা নন। আর নীরা কোনো নির্দিষ্ট একজন নন। তিনি জানান- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারী এসেছিলেন কবির জীবনে। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো নীরা ছিলেন। অথবা একাধিক নারীর ছায়া নিয়েও নীরা হতে পারে। সুনীল নাকি কখনো স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কেও খুলে বলেননি নীরা সম্পর্কে।

ভারতের ‘দেশ' পত্রিকার সম্পাদক হর্ষ দত্ত সুনীলের এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন-“ আপনার ‘নীরা’কে নিয়ে বহু কবিতা, প্রশ্ন, কৌতূহল ছিল, আজও আছে। কেমন লাগে আপনার?”

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উত্তরে ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিলেন- “মানুষের কৌতূহল থাকে থাক, সব মেটাবার দরকার নেই। নীরা বিষয়ক সব প্রশ্নের উত্তরে আমি বলি, সব উত্তর ওই কবিতাগুলির মধ্যেই নিহিত আছে।’’

বলাকা’য় প্রকাশিত এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নীরা’কে নিয়ে ধারাহিকভাবে লেখার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুনীল বলেন, “প্রথমে লেখার সময় ভাবি নি ধারাবাহিকভাবে লিখব। আর দ্বিতীয় কথা নীরাকে নিয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি চাই ন কারণ দিলে ব্যাপারটা আর থাকবে না। পড়ে পড়ে মানুষ যেরকম মানে বুঝবে। প্রথম কবিতাটাই তো হঠাৎ নীরার জন্য। হঠাৎ করেই মাথায় এসেছিল, তারপর মাঝে মাঝে ওটা মনে আসত। নীরা কথাটাকে নিয়ে কেমনভাবে খেলান যায় ভাবতাম। তারমধ্যে একটা সিগনিফিক্যান্ট লেখা আছে শেষের দিকে, এই নীরা যে কোনো নারী হবে। মাঝে মাঝে মনে এসেছে মাঝে মাঝে লিখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এটা শিল্প হয়ে যাচ্ছে। শিল্প হলে মূর্তি হয়ে যাচ্ছে। আমি তা নিজের রাখতে চাই। মূর্তি হয়ে যাবে তা থেকে আমি ফিরিয়ে এনে রক্ত মাংসের করতে চাই।”

স্পষ্টভাষী সুনীল নীরার ব্যাপারে কখনোই খোলাখুলি কথা কেন বলেননি তার উত্তর দিয়েছেন হয়তো তার ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ কবিতায়। প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন—

“এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি,

এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?”

সুনীল অনেকটা বুঝিয়েই দিয়েছেন নীরা তাঁর একা নিভৃত প্রেমিকা। তাঁর সেই প্রেমের কথা তিনি নীরাকেও জানাতে চান না। শুধু নীরবে ভালোবেসে যেতে চান।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর আমাদের মাঝে নেই। আজ ৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার তাঁর ৮৮তম জন্মবার্ষিকী। বেচে থাকলে এদিন তাঁর বয়স হতো ৮৮। সুনীল পাড়ি দিয়েছেন অন্য জীবনের খোঁজে। তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মতো নীরাকেও বাঙালি পাঠক বড় যতেœ  রেখেছে। সুনীল অমর হয়ে আছেন নীরার মাঝে। সুনীল চলে যাবার পরও যুগ যুগ রোমান্টিক কবিতার চরিত্র হিসেবে চিরযৌবনা নীরা বেঁচে থাকবে অসংখ্য যুবকের মানসপটে।

এক সময় নীরা প্রাণ পেয়েছিল সুনীলের কলমে। আর আজ জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কবি সুনীল আর নীরা এক অভিন্ন সত্তা। সেই সত্তার উদ্দেশ্যে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহসী উচ্চারণ—

“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ

আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?”

 

তথ্যসূত্র:

১.       সুনীলের নীরা, নাকি নীরার সুনীল, প্রশান্ত ভৌমিক, ২০১৮

২.       সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা: বিচিত্র রূপে নারীকে দেখা, সুব্রত মÐল, অনুরণন, ভলিউম-২, ইস্যু-২, ২০১৪

৩.       সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, বলাকা পত্রিকা  

 

Link copied!