বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ আজ। অতীতের গ্লানি, দুঃখ, জরা মুছে অসুন্দর ও অশুভকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে এসেছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০।
পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি। তাতে অবগাহন করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক সম্প্রীতি— এমন কামনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কলি ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’।
শোভাযাত্রা শাহবাগ মোড় হয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়। তবে রোজার মাস হওয়ায় এবারের পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়নি।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বলেন, প্রত্যাশা ও সফলতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখন এটি ওয়ার্ল্ড মেমোরি অব হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এটি অসাধারণ সম্পদ। সেটির রক্ষণাবেক্ষণ, সেটি সংরক্ষণ ও সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এখন সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব এবং এটি অন্তর্ভুক্তমূলক দৃষ্টি ও দর্শনের প্রতিফলন। এটির মাধ্যমে এটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার বার্তা সময়ে সবসময়ই দিয়ে থাকে। যে আতঙ্ক ছিল সেটির প্রতিবাদে সকল মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সকল ধরনের সকল উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এটি একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক আহ্বান।
এবারের শোভাযাত্রায় প্রধান আকর্ষণ দুই মোটিফ হলো- মায়ের কোলে শিশু এবং নীলগাই। মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ, প্রতীকীভাবে বৈশ্বিক শান্তির বার্তা। এ ছাড়া বিপন্ন হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের প্রতীকী হিসেবে রাখা হয়েছে নীলগাই। এছাড়া আরও চারটি মোটিফ শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত হয়। সেগুলো হলো বাঘ, ময়ূর, ভেড়া ও হরিণ।
একইসঙ্গে শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মুখোশ, পেঁচা, ঘোড়া, পুতুল, নকশি পাখি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগতরা কোনো ধরনের মুখোশ পরেননি এবং ব্যাগ বহন করেননি। তবে চারুকলা অনুষদ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেউ ভুভুজেলা বাঁশি বাজায়নি। এছাড়া, ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন ও মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন সকল স্তরের মানুষ। শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা নারীদের অনেকের পরনে শাড়ি আর মাথায় নানা রঙের ফুলের সমন্বিত টায়রা। পুরুষদের পরনে পাঞ্জাবি। সবারই চোখে-মুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।
শোভাযাত্রাকে ঘিরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কড়া নিরাপত্তায় উৎসবের আনন্দ ছিল বাঁধভাঙা। শোভাযাত্রা শেষে প্রদর্শিত মোটিফগুলো চারুকলা অনুষদে রাখা হয়। সেখানে যাওয়ার পর ঢাকের তালে উচ্ছ্বাসে মাতেন শিক্ষার্থীরা।
গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অন্ধকার ঘোচানোর আহ্বানে পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। এটিই পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। সেই সময় থেকে চারুকলা অনুষদের নেতৃত্বে প্রতিবছর উদযাপিত হয় এই উৎসব।