ঐতিহাসিক ৬ দফার ভেতরেই স্বাধীনতার ১ দফা নিহিত ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন ৬ দফা মানেই ১ দফা। অর্থাৎ স্বাধীনতা।
সোমবার (০৭ জুন) ঐতিহাসিক ছয়-দফা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত (পূর্ব রেকর্ডকৃত) একটি অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, 'এই ৬ দফার ভেতরেই এক দফা নিহিত ছিল, সেটা অন্তত আমরা পরিবারের সদস্যরা জানতাম। তিনি সব সময় বলতেন ৬ দফা মানেই ১ দফা। অর্থাৎ স্বাধীনতা। আজকে আমরা সেই স্বাধীন জাতি।'
কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং ৬ দফার দাবিতে আন্দোলন করতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন শহীদের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'এই ৭ই জুনে রক্তের অক্ষরে এই ৬ দফা দাবির কথা লিখে গিয়েছিল বলেই এই ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচন এবং আমাদের যুদ্ধে বিজয়। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।'
টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সেই হরতালে অনেক মানুষকে তারা হত্যা করেছে। ১১ জন সেখানে জীবন দেন। রক্তের অক্ষরে ৬ দফা তারা লিখে যায়, আর যেই ৬ দফার ভিত্তিকে ৭০ এর নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন পায়, যেটা পাকিস্তানিরা কোন দিনই আশা করেনি।'
'এর পর অসহযোগ আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দেন। অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব থেকে বিজয় অর্জন আমরা করেছি।'
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ছাত্রজীবন থেকে এদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন। বাঙালি জাতির একটা উন্নত জীবন পাবে, সুন্দর জীবন পাবে এটাই তার আকাঙ্খা ছিল। তিনি সেটাই চেয়েছিলেন। তার সব সময় চিন্তা ছিল কিভাবে এ জাতিকে দুঃখ দারিদ্র থেকে মুক্তি দেবেন, ক্ষুধা-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়ে একটা উন্নত জীবন দেবেন।'
তিনি বলেন, 'পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালির জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যে চিন্তা চেতনাগুলোর তার (বঙ্গবন্ধু) ভেতরে লালিত ছিল সেটাই প্রতিফলিত হয়েছিল ৬ দফা প্রণয়নের মাধ্যমে। আর সেটা তার আরও সুযোগ এসে গেলো ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। যখন দেখা গেল এই ভুখন্ডের মানুষ সম্পূর্ণ ভাবেই নিরাপত্তাহীন। সেই সময় তিনি এই ৬ দফা দাবিটা উত্থাপন করেন।'
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, '৬ দফা দাবি উত্থাপন করার সাথে সাথেই পাকিস্তানি শাসকদের কথা ছিল এটা সম্পূর্ণ ভাবে বিছিন্ন করার জন্য এই দাবি তিনি তুলেছেন। কিন্তু সেটা বাস্তব না। তিনি মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। '
৬ দফা দাবিকে জনগণের দাবিতে রূপান্তর করতে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ৬ দফা দাবিকে জাতির পিতা নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের বাঁচার দাবি হিসেবে। তিনি যখন ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। '
দলের অনেকের দ্বিধাদন্ধ থাকার মধ্যেই পরে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফাকে গ্রহণ করা হয় বলে জানান তিনি।
এরপর ১৯ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'সেখানে তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন ৬ দফা প্রশ্নে কোন আপোষ নাই।'
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এরপর ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে জনসভা হয়, সে জনসভায় সকলে ভাষণ দেন এবং ৬ দফাকে গ্রহণ করেন। তারপর তিনি (বঙ্গবন্ধু) শুরু করে সারা বাংলাদেশ সফর। তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আনাছে-কানাছে সফর করেন। একদিকে দলকে সংগঠিত করা এবং ৬ দফা দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন আদায় করা। সেই সাথে সাথে ৬ দফার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। ... জনগণ এই ৬ দফাকে খুব দ্রুত মেনে নেয়।'
তিনি বলেন, '৬ দফা দেবার পর আন্দোলন চলতে থাকে, তিনি সফর করতে থাকেন... ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনসভা শেষে ফিরে আসার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোরসহ খুলনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, যেখানেই জনসভা করেছেন বিভিন্ন জায়গায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, বক্তৃতার করার কারণে, তাকে গ্রেফতার করেছে, তাকে জেলে নিয়েছে, আবার সেখান থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আরেক জায়গায় তিনি জনসভা করেছেন। ... তিনি কিভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিনি নিজের জীবনকে কিভাবে উৎসর্গ করেছিলেন তার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেই কথাগুলো উঠে এসেছে।'
৭ই জুনের হরতাল সফল করতে নিজের মায়ের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, 'মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে এবং ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন চলছিল তিনি কারাবন্দী থাকা অবস্থায়। তখন ৭ই জুন হরতাল ডাকা হয়। এখানে আমি আমার মায়ের কথা বলবো। এই হরতাল সফল করার জন্য আমার মা বিশেষ ভুমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে, সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে হরতাল সফল করার জন্য কাজ করেছেন।'
তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সম্মেলনের ডাক দেয়। সে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব প্রদান করেনি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ৬-দফা উত্থাপন করেন।
৬-দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দু’টি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন।
৬ দফা দাবি আদায় এবং কারাবন্দী শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঢাকাসহ সারা বাংলায় আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল পালিত হয়।
সেদিনের সে হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ ১১ বাঙালি শহীদ হন, গ্রেপ্তার হন অনেকে।
ঘটনাবহুল ৭ই জুনকে ঐতিহাসিক ছয়-দফা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।