জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যা মামলাকে ঘিরে বিতর্ক, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কারাগারে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২০, ২০২৫, ০২:১২ পিএম

জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যা মামলাকে ঘিরে বিতর্ক, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কারাগারে

ছবি: সংগৃহীত

রংপুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি হত্যা মামলাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে আদালতের নিদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

গ্রেপ্তার মাহমুদুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। গত আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বামীকে হত্যার অভিযোগে ৩ জুন রংপুর নগরের হাজিরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা করেন রংপুর নগরে রাধাকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা আমেনা বেগম (৬০)। এ মামলার ৫৪ নম্বর আসামি মাহমুদুল হক।  

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কর্মসূচি বানচাল, প্রয়োজনে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হত্যা করাসহ আন্দোলন প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। রংপুরের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠনের উল্লেখিত নেতাকর্মীরা গত বছরের ২ আগস্ট তার স্বামী ছমেস উদ্দিনকে বাড়িসংলগ্ন মুদিদোকানের সামনে দেশি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে শরীরে বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর জখম করেন। পরে তাকে রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত আটটার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

তবে ছমেস উদ্দিনের কবরে টাঙানো সাইনবোর্ডের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সেখানে ছমেস উদ্দিনকে ‘জাতীয় বীর’ উল্লেখ করে লেখা আছে, ‘২ আগস্ট ২০২৪ পুলিশ বিভাগের একটি দল তার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি পুলিশ দেখে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে যান। তিনি সেখানে স্ট্রোক করে মারা যানতা নিশ্চিত করেন প্রাইম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক।’

মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ

রংপুর নগরের ধাপ ইঞ্জিনিয়ারপাড়া এলাকার বাসা থেকে গতকাল দুপুরে শিক্ষক মাহমুদুল হককে আটক করে মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানার পুলিশ। বিকেলে তাকে আদালতে তোলা হয় এবং বিচারক কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মাহমুদুল হকের স্ত্রী মাসুবা হাসান অভিযোগ করেন, যে হত্যা মামলায় মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি (ছমেস উদ্দিন) হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। মামলার বাদীর কাছ থেকে হাজিরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন। পরে ইচ্ছামতো আসামি করেছেন। আমার স্বামীকে মূলত পরিকল্পনা করে ফাঁসানোর জন্য এটা করা হয়েছে। এর পেছনে আছেন দুজনএকজন চিকিৎসক, অন্যজন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। আমি তাদের নাম এখন বলব না। এর আগেও ওই দুজন আমার স্বামীকে মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিলেন।’

মামলার এজাহারে দেওয়া আমিনা বেগমের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে ফোন ধরেন তার ছেলে আশিকুর রহমান। আশিকুর বলেন, তার বাবা ২ আগস্ট মারা গেছেন। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন না। তবে যতটুকু শুনেছেন, ওই দিন প্রশাসনের কিছু লোক ছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু লোক ছিলেন।

আশিকুর বলেন, ‘আব্বু মুদিদোকান করেন। পুলিশ দেখে উনি দৌড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। ওখানে আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন, প্রশাসনের লোক ছিলেন, তারা পেছন থেকে ধাওয়া দেন। ওখানেই উনি পড়ে যান। তারপর কী হয়েছে, কী হয় নাই, আমি বলতে পারি না।’ মামলার আসামি মাহমুদুল হককে চেনেন কি না জানতে চাইলে আশিকুর বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী।

রাধাকৃষ্ণপুরের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রংপুর নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সাবেক আমির নাছির উদ্দিনের বাড়ি রাধাকৃষ্ণপুর মৌলভীপাড়ায়। বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনের সময় তার বাড়িতে যান সাদাপোশাকের ৯ পুলিশ সদস্য। তিনি তথ্য পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওই সময় মুদিদোকানি ছমেস উদ্দিন ভয়ে পালানোর চেষ্টা করেন এবং হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এ সম্পর্কে নাছির উদ্দিন বলেন, ‘ওই দিন ২ আগস্ট নয়; ২ জুলাই ছিল। তিনটি মোটরসাইকেলে সাদাপোশাকে ৯ পুলিশ সদস্য আমার বাড়ির দিকে আসেন। আগেভাগে জানতে পেরে আমি বাড়ি ছাড়ি। পরে রাতে জানতে পারি, ছমেস পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। মূলত এটা (মামলা) সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, সাজানো নাটক। ছমেস উদ্দিন হার্টের রোগী ছিলেন। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে ঢাকায় তার রিং লাগিয়ে আনা হয়েছিল।’ খবর প্রথম আলো।

‘মামলায় ওসির আগ্রহ বেশি’

ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রংপুর নগরের বাসিন্দা রুবায়েত হোসেন। তার ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সংগঠক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইউশা মোহন রাতুল বলেন, ‘আমার বাবা জুলাই আন্দোলনের গেজেটভুক্ত আহত। অথচ তাকে নগরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দেখানো হয়েছে। এই মামলায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।’

ইউশা মোহন অভিযোগ করেন, হাজিরহাট থানার ওসি আবদুল আল মামুন শাহ মামলা রেকর্ড করে নিজেই তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ মামলায় ওসির আগ্রহ বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি আবদুল আল মামুন শাহ বলেন, তারা তদন্ত করে যাচাই-বাছাই করে অভিযোগপত্র দেবেন। তার বিরুদ্ধে মামলা সাজানো, মামলাবাণিজ্য ও নির্দোষ ব্যক্তিকে আসামি করে হয়রানির অভিযোগ সঠিক নয়।

গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তারের খবর জানাজানি হলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা হাজিরহাট থানায় গিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চান ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, মাহমুদুল হক জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ফেসবুকে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও কোটা সংস্কারের আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্দোলনের পক্ষের শক্তিকে মিথ্যা, ভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

Link copied!