বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

জীবিত মানুষকে জুলাই আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে হত্যা মামলা!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৩০, ২০২৫, ০৪:৩০ পিএম

জীবিত মানুষকে জুলাই আন্দোলনে শহীদ দেখিয়ে হত্যা মামলা!

ছবি: বিবিসি বাংলার ভিডিও থেকে সংগৃহীত।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানায় একটি হত্যা মামলায় মৃত হিসেবে উল্লেখ করা হয় সুলাইমান সেলিমকে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার পুলিশ যখন ঠিকানা যাচাই করতে যান তখনই সেলিম জানতে পারে তাকে মৃত দেখিয়ে হত্যা মামলা করা হয়েছে।

এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এতে ভুক্তভোগী সুলাইমান সেলিম বলেন, “খুব কষ্ট, খুব কষ্ট ভিতরে। যদি বুক ছিড়া দেখাইবার পারতাম আমি জীবিত থাকতে মৃত… হামার বড় ভাইয়ে দেখাইছে বাংলাদেশের সরকাররে আমি মারা গেছি। এর থেকে দুঃখ কী আছে পৃথিবীতে?’  

তিনি বলেন, ‘৩ আগস্ট, ছাত্র আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ি কাজলা এলাকায় বলে মারা গেছি। কউ গুলি খাইয়া বলে মারা গেছি।’

বিবিসির প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করেন যে, আপনিই যে সে সেলিম সেটা নিশ্চিত তো? উত্তরে সুলাইমান সেলিম বলেন, ‘হ্যা, নিশ্চিত।’ বলেন, ‘এর মাঝখানে যদি মাইরা ফেলত পুলিশ জানার আগে তাইলে তো আমি সরকারি লাশ হইয়া যাইতাম।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, ভুক্তভোগী সেলিম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গতবছর ৩১ আগস্ট উক্ত মামলাটি করেন সেলিমের আপন ভাই মোস্তফা কামাল। সাক্ষী হিসাবে থাকা দুজনের নামও তার আরও দুই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে যায়। নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে তিনি ঢাকার আদালত, ডিবি অফিস ও থানায় পাঁচবার হাজিরা দিয়েছেন।

সুলাইমান সেলিম বলেন, ‘চারবার গেছি যাত্রাবাড়ি আর একবার গেছি ডিবি অফিসে। এই মামলাটা করছে শুধু আমাকে মারার জন্য যদি এর মাঝখানে আমাকে মাইরা ফেলতে পারত তাহলে অই যাগরে আসামি করছিল ৪১ জন আর অজ্ঞাত এক দেড়শ জন, তারা অযথা জেল খাটত।’

সুলাইমান সেলিম জানান, তিনি প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ফুলবাড়িয়ার ধামরে এই ঘটনা চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। জুলাই আন্দোলনকে ব্যবহার করে এমন হত্যা মামলা নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যাত্রাবাড়ি থানার ওই মামলার প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। এছাড়া ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৪১ জনের নাম দেয়া হয়েছে। এছাড়াও অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের আরও দেড় থেকে দুইশ নেতা-কর্মীকে।

যাত্রাবাড়ি থানায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, মোস্তফা কামালের মামলাটি রুজু অবস্থায় রয়েছে এবং গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি মামলাটির তদন্ত করছে।

ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মামলার বাদী এখন পলাতক। সেলিম জীবিত কি না তা নিশ্চিত হতে আদালত ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘মানে একজন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে তারই আত্মীয়-স্বজন মামলা করছেন এটি কল্পনার বাইরে। এটি সরাসরি জুলাই-আগস্টের শহীদদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মতো ঘটনা।’  

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর ভূয়া হত্যা মামলা দিয়ে হয়রানি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঢালাও মামলা দায়েরের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া একটি হত্যা মামলায় আটক হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে।

মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘যারা যারা জড়িত, সত্যিকারভাবে তাদেরকে বিচারে আনা উচিত এবং দ্রুত বিচার করা উচিত। কিন্তু এটা করতে গিয়ে এমনকিছু করা উচিত না যেটা অন্যান্য যারা সাধারণ মানুষ, যারা নিরীহ মানুষ, যারা জড়িত ছিল না তাদেরকে নিয়ে এসে… একধরণের ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাকে দূর্বল করার যে প্রবণতা সে প্রবণতা থেকে যারা করছে তাদেরও বিচার করা উচিত যে তুমি এ কাজটা কেন করতেছো। তাহলে তারা যখন থেমে যাবে তখন কিন্তু এধরণের ঘটনা আর ঘটবে না। এধরণের ঘটনা ঘটছে তা আমাদের কাছেও (তথ্য) আছে, আমাদের নলেজেও আছে।’

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে দেড় হাজারের মতো মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০০টি হত্যা মামলা। এসব মামলা তদন্তে মনিটরিং করার কথাও জানিয়েছিল পুলিশ। মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, উদ্দেশ্যমূলক মামলা ও এধরণের মামলার কারণে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হবে।

নূর খান লিটন বলেন, ‘হুকুমের আসামি হতে পারে কিন্তু উপস্থিত থেকে গুলি চালানো এই জায়গাটিতেও আমরা দেখছি নাম দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যপক মাত্রায় এই মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে, একটা হচ্ছে মামলা দেয়ার আগে এক ধরণের চাঁদাবাজি আমরা লক্ষ্য করেছি, যে মামলা তৈরি হচ্ছে টাকা দাও তাহলে মামলায় নাম দেব না। মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্যও এক ধরণের চাঁদাবাজি হচ্ছে।’  

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর বিতর্কিত হত্যা মামলায় আটক, মব সৃষ্টি, গ্রেপ্তারের পর আদালতে হামলার মতো ঘটনা উদ্বেগজনক হিসেবে দেখেন মানবাধিকারকর্মীরা।

নূর খান লিটন বলেন, ‘মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, বা একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু মানুষকে ইচ্ছাকৃত জড়িয়ে দিয়ে হয়রানি, তারপর মব ক্রিয়েট করে সন্ত্রাস তৈরি করা –এগুলো সবই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এগুলো যেমন সামাজিক ও ফৌজদারি অপরাধ তেমনই অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।’

আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক একটা বিষয়, ৫ আগস্টের আগে যে ঘটনাগুলো আগে ঘটেছে হাসিনা সরকারের সময় তখন কিন্তু আমরা অনেকসময় বলেছি যে মিথ্যা মামলা, হয়রানি হাজার হাজার লোক সাফার করেছে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন লোক। ঠিক সেটাই যদি আবার পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক একটা বিষয়।’  

আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সেলিমের মতো জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে মামলা সামনে আসায় জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলাগুলো নিয়ে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। মামলাগুলো যাচাই বাছাই এবং সুষ্ঠ তদন্তের জন্য প্রয়োজনে টাস্কফোর্সও গঠন করা যেতে পারে।

Link copied!