জুন ১৬, ২০২৫, ০৪:২৯ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
ঈদের ছুটির পর আবার আন্দোলনে ফিরেছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ বাতিল না হলে মঙ্গলবার সচিবালয়ের বাদামতলায় বড় জমায়েতের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরাম।
সোমবার, ১৬ লজুন জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদের নতুন ভবনের নিচে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন ঐক্য ফোরামের নেতারা।
সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-মহাসচিব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আগামীকাল (মঙ্গলবার) থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক মিছিল নিয়ে আসবেন। উপদেষ্টা দপ্তর, সচিবের দপ্তর এবং প্রশাসন শাখা থেকে পৃথক পৃথক মিছিল নিয়ে আসবেন। দরকার হলে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে আসবেন। বলবেন- এখানে আয় ব্যাটা। বাদাম তলায় সকাল ১১টায় মিলিত হবেন।”
আইন উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আইন উপদেষ্টা মন্তব্য করলেন যে, আইন পাশ হওয়ার সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। এমনভাবে মন্তব্য করলেন যে, আমি যদি থাকতাম এই আইন বাস্তবায়ন হত না। চেয়ারে বসে বড় বড় কথা বলেন, উল্টা পাল্টা কথা বলেন। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। আপনাদের উদ্দেশ্য কী?
“ফ্যাসিস্ট সরকার চলে যাওয়ার পর গত ১০ মাসে আমাদের মাঝে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি। তারও পরেও আমাদের মনে আগুন জ্বালানোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”
সেলিম বলেন, “আমরা মাস্তান নই। রাজপথে গলাফাটানোর লোক আমরা নই। আমাদের কেন অশান্ত করলেন? আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার একদিনে ফ্যাসিস্ট হয় নাই। এই সরকারের ভেতরেও ফ্যাসিস্ট আছে, আমরা কিন্তু চিনি। শুধু এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই চেনে, ব্যাপারটি এমন নয়। আমরাও কিন্তু চিনি। আপনাদের মন মানসিকতা আমরা বুঝি।”
কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়েছে ৭ জুন। ঈদের আগে ৫ জুন থেকে পরবর্তী ১৪ জুন পর্যন্ত টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করে সরকার।
ছুটির পর রোববার কর্ম দিবসে কর্মচারী আন্দোলনের নেতা সেলিম বলেন, “আজকে কোন কর্মসূচি নেই, আজকে শুধু কোলাকুলি।”
এদিন সবার সঙ্গে আলোচনা করে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
উপদেষ্টা পরিষদ গেল ২২ মে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করার প্রস্তাবে সায় দেয়।
এর প্রতিবাদে ২৪ মে সকাল থেকে দিনভর সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের আপত্তির মধ্যেই রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৫ মে রাতে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
সেখানে পুরনো আইনের সঙ্গে ‘৩৭ক’ নামের আরেকটি ধারা সংযোজন করা হয়।
নতুন ধারায় একজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে দুই দফায় সাত দিন করে নোটিসের পর, দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা রাখার বিধান রাখা হয়েছে।
সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে জারি করা অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান বাদিউল কবীর বলেন, “সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের আচরণ খুবই পরিশীলিত এবং তারা খুবই আনুগত্য পরায়ণ। তাদের অহেতুক, অন্যায় ও নিবর্তনমূলক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তোলার ব্যবস্থা করছেন। আপানারা কোনো টালবাহানা না করে এই আইন প্রত্যাহার করুন।”
ঐক্য ফোরামের আরেক কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, “বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস ইতোমধ্যেই আন্দোলনে নেমে গেছে। সরকার আমাদের সাথে সাপলুডু খেলা খেলতেছে। আমরা মহার্ঘ ভাতা, পদবি পরিবর্তন, সচিবালয় ভাতা চেয়েছিলাম। এর উত্তরে আসলো অভিন্ন নিয়োগবিধি। সেটা আমরা থামাইলাম। এরমাঝে আবার গোপনে গোপনে নিয়ে আসলো কালো অধ্যাদেশ।
“এই মুহূর্তে এই ধরনের অধ্যাদেশের অধিকার তাদের নেই। আমরা ধিক্কার জানাই। যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আমরা তাদের ধিক্কার জানাই। এই সাপলুডুর খেলা বন্ধ করতে হবে।”
আন্দোলন চলার মধ্যেই ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধার’ ঘোষণা আসে।
সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ‘বিশেষ সুবিধা’ দিয়ে পরের দিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এই ‘বিশেষ সুবিধা’ প্রত্যাখ্যান করে নুরুল ইসলাম বলেন, “বিশেষ সুবিধা ভাতার নামে একটা ফাঁকিবাজি ভাতা দিয়েছে সরকার। এটা বিশেষ সুবিধা নয়, এটা বিশেষ প্রতারণা। আমরা এই বিশেষ প্রতারণা মেনে নেব না। আমাদের কথায় গুরুত্ব না দিলে বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ ডাকতে বাধ্য হব।”
সমাবেশে সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-মহাসচিব নজরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, সোহেল রানা, হাসনাত, গোলাম রব্বানি, বিপুল উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ ভবনের নিচে মিছিল শেষে কর্মচারীরা মিছিল নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের দপ্তরে স্মারক লিপি দেন।
অধ্যাদেশে ‘আচরণ বা দণ্ড সংক্রান্ত’ বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে-
কেউ যদি এমন কাজ করে যা অনানুগত্যের সামিল এবং যা অন্য কর্মচারীদের মাঝে অনানুগত্য সৃষ্টি করতে পারে বা শৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটাতে পারে বা অন্যের কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে;
এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে ছুটি ব্যতীত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে। কাউকে কর্মবিরতিতে বাধ্য বা উস্কানি দেওয়া, অন্য কর্মচারীকে কাজে বাধা দেওয়া হলে;
কোনো কর্মচারীকে তার কর্মস্থলে আসতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে।
এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে পদাবনতি বা গ্রেড অবনতি, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
এসব অসদাচরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গঠন, সাত দিনের সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারণ জানিয়ে জবাব না দিলে আবার সাত দিনের নোটিস দেওয়ার পর তা বিবেচনা করে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর আপিল রাখার সুযোগ রয়েছে। দণ্ডের নোটিস হাতে পাওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করা যাবে।
নতুন এই অধ্যাদেশকে আন্দোলনকারীরা বলছেন ‘নিবর্তনমূলক কালো আইন’।
এর পর সচিবালয়ে আন্দোলন বিক্ষোভ আরো জোরদার করেন কর্মচারীরা। ওই সময়ে অধ্যাদেশ সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিলের দাবি তোলেন আন্দোলনকারীরা।
পরে ভূমি সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পরিসংখ্যান সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই আন্দোলনের বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে তুলে ধরেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা।
জাপান সফর শেষে দেশে ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ।
মাঝে একদিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত রেখেছিলেন আন্দোলনরতরা। পরে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।