জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ০১:২৮ পিএম
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ মঙ্গলবার ৫০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে তারা বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সেই পুরোনো নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফিরেছে, যা বাংলাদেশের জন্য “সংকটজনক”।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণহারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গণগ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মতো ভূমিকা থেকে সরে আসার পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তার বন্ধ করতে বলেছে এইচআরডব্লিউ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, যেমন “স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতা” বন্ধ করতে হবে। নইলে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত কিছু “গুরুত্বপূর্ণ” পদক্ষেপ ব্যাহত হতে পারে।
এতে আরও বলা হয়, পুলিশ আবারো স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন বাছ-বিচার ছাড়াই ফৌজদারী মামলা দায়ের করছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে যে কোনো অবস্থায় হয়রানি করার অবাধ সুযোগ পাচ্ছে।
পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধে সংস্কার এবং বেসামরিক তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি।
একই সঙ্গে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে খামখেয়ালিভাবে ভিন্নমত দমনে যাকে-তাকে মামলায় আসামি করা ও মোটাদাগে অভিযোগ আনার সংস্কৃতি থেকে থেকে বের হয়ে আসার কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ।
কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে দ্রুত ও নিরাপদে বিচারকের সামনে হাজির করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আদালতকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “গ্রেপ্তারের পর থানা ও হেফাজতে রাখা কেন্দ্রগুলোকে জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা ও স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ রাখতে হবে।”
এতে আরও বলা হয়, “সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, সামরিক ও বিচার বিভাগসহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ভূমিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে বলেছে এইচআরডব্লিউ। টেকসই সংস্কারে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) অনান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।”
একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারকে দ্রুত গুম বিষয়ক অনুসন্ধান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বিশেষায়িত ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে (র্যাব) বিলুপ্ত করারও জোর দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি। অসংখ্য গুম-খুন-নির্যাতনের ভয়াবহ অভিযোগ ওঠে ওই বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া পরিচালক এলিন পিয়ার্স বলেছেন, “বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারকে গত ১৫ বছরের আবদ্ধ স্বৈরাচারের অবস্থা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “অন্তবর্তী সরকারের উচিত টেকসই কাঠামোগত সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের সমর্থন তালিকাভুক্ত করা এবং অতীতের অপব্যবহার যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নীলনকশা হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা।”
এলিন পিয়ার্স আরও বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করতে পারলে বহু প্রাণের বিনিময়ে কষ্টার্জিত এ অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে। একই সাথে ভবিষ্যতের সরকারকে যেকোনো দমন-পীড়নমূলক ভূমিকা নেবার পথ সহজ করে দেবে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, “অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা, বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে মেরামত করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকার আরও বলেছে, তারা রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনগত পরিবর্তন আনবে, যা পরবর্তীতে নির্বাচিত সংসদ অনুমোদন দেবে।”
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “আওয়ামী লীগের আমলে বাকস্বাধীনতাকে দমন করতে নিবর্তনমূলক আইনটি করা হলেও, অন্তবর্তী সরকার ওই আইনের পরিবর্তে একটি নতুন অধ্যাদেশ চালু করেছে। দুর্ভাগ্যবশত নতুন অধ্যাদেশে আগের আইনের মতোই অনেকগুলো ক্ষতিকারক ধারা-উপধারা রাখা হয়েছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ছাত্র নেতৃত্ব ও কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা বেষ্টিত। অনেকেই উদ্বিগ্ন প্রকাশ করে বলেছে, সংস্কারের গতি দৃশ্যমানভাবে কমে গেছে।”
এতে আরও বলা হয়, “ইউনূস তার প্রশাসনের বাকস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার ওপর জোর দিয়েছেন।”
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “নভেম্বর পর্যন্ত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকা রাখার অভিযোগে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। এছাড়া, সরকারি দপ্তরগুলোতে সংবাদ সংগ্রহের জন্য ১৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছে।”
“সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল”
অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংস আক্রমণকে “নজিরবিহীন” উল্লেখ করে প্রতিবেদনে সহিংসতার কিছু বর্ণনাও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “হাসিনা সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে নির্বিচারে জনতার ওপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট এবং তাজা বুলেট ব্যবহার করেছিল। সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল।”
একজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, “আমি পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে গুলি চালাতে দেখেছি... অনেক ক্ষেত্রে, অফিসারদের জীবন বিপদে না থাকলেও আমি সরাসরি গুলি চালাতে দেখেছি।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বর্ণনা করেছেন যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দেন, যেন তারা ভিডিও গেমে কাউকে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “ভয় তৈরি করার উদ্দেশ্যে পুলিশ বিভিন্ন মানুষজনকে বাড়ির জানালায় অবস্থান করার সময়ও গুলি চালায়।”
পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের জন্য স্পষ্ট এবং অন্তর্নিহিত উভয় নির্দেশ পেয়েছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কঠোর হতে এবং ‘অরাজকতা’ ছড়ানো কোনও অপরাধীকে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে "গুলি কর" শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল; সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন, কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুন।”
র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ
প্রতিবেদনে টেকসই সংস্কারে সুপারিশের মধ্যে আরও বলা হয়েছে, গণগ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামা মামলা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। আটক ব্যক্তিকে যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারকের সামনে হাজির করা যায়। আটকে রাখার স্থান যাতে পরিদর্শন করা যায়। সেই সঙ্গে রিমান্ডের প্রচলনে নিষেধাজ্ঞা আনতে হবে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সাংবাদিককে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রিমান্ডে নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন করে থাকে। এ ছাড়া যেসব আইন জবাবদিহির পথে বাধা, সেসব আইনকে সংশোধন বা বাতিল করার পরামর্শ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন করতে হবে। এদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাদের পদোন্নতি থেকে শুরু করে নিয়োগে যাতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকে।”
কাঠামোগত সংস্কার করা হলে র্যাবকে কেন বিলুপ্ত করতে হবে? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, র্যাবকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। র্যাবকে সংস্কার করা সম্ভব নয় বলে এ বাহিনীকে আমরা আলাদা করে দেখছি। র্যাবকে যে কাঠামো ও ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে, তাতে সমস্যা আছে। সরকার যে কোনো কাজেই এ বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে, সেটা যত নিপীড়নমূলকই হোক না কেন।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিতর্কে এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “আমরা সম্প্রতি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বিবৃতি দেখেছি। যেখানে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধের বিষয়টি তোলা হয়েছে, এটি বেশ উদ্বেগের। কারণ বাংলাদেশিরা হয়তো আরেকটি নির্বাচন পেতে যাচ্ছে, যেখানে তারা পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারবে না।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বদলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে—জানতে চাইলে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “সঠিক উপায়ে তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে বিচার করা।”
প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও (আইসিটি) সমালোচনা করা হয়েছে। অতীতে এটিকে ব্যবহার করে অস্বচ্ছ বিচার করা হয়েছে। আইসিটি আইনে এখনও অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক মানের নয়। এখানে মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় এমন ধারা রয়েছে। যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচার করা। নভেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে শেখ হাসিনাসহ ৮০ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
যারা অনুপস্থিত, তাদের বিচার কীভাবে করা যাবে—জানতে চাইলে এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, “উপস্থিতি নিশ্চিত করে বিচার করতে হবে। কারণ অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।”
শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, “আইসিটি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে শেখ হাসিনাকে ফেরানো সহজ হবে না। বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করার পাশাপাশি আইসিটি আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করলে শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চাপ দেওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।”
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড।