জুন ২৫, ২০২৪, ০৪:৪৮ পিএম
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক বিগত ১৫ বছরে একটি অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। যার সুফল দুই দেশের জনগণ ভোগ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার (২৫ জুন) গণভবনে দুই দিনের ভারত সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এই কথা বলেন তিনি।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চলমানতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যারা অপব্যাখ্যা দেয় তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা দেশ বিক্রির কথা বলেন, তারা পাকিস্তানের দালালি করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, গত বছর আমি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ-খাতে চারটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথভাবে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে আমি ভারতের আমন্ত্রণে জি-২০ সম্মেলনে যোগদান করেছি। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই নতুন সরকার গঠনের পর এই সফর অনুষ্ঠিত হলো।
এক মাসে দুইবার দিল্লি সফর
শেখ হাসিনা তার লিখিত বক্তব্য পাঠের সময় বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের নতুন সরকার গঠনের পর এটিই ছিল কোনও দেশে আমার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠনের পর ভারতেও ছিল এটি প্রথমবারের মতো কোনও রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার-প্রধানের দ্বিপাক্ষিক সফর।
এটা অবশ্যই আমার ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতামূলক বিশেষ সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ। একই মাসে সরকার প্রধান হিসেবে দুইবার দিল্লি সফর আমার জন্য অভূতপূর্ব এক ঘটনা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে গত ২১ জুন দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া গত ৯ জুন ভারতের টানা তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ৮-১০ জুন নয়াদিল্লি সফর করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ভারতের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোর একাধিক সরকারপ্রধানের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। পাশাপাশি আলাদাভাবে ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সরকার প্রধানগণের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ভিশন
উভয়দেশ শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিতকরণে একটি রূপকল্প ঘোষণা গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ ও ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করতে আমরা দু’পক্ষই সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত।
এছাড়াও শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেহেতু নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে, সেই ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ নিশ্চিতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি।
সব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দিল্লি সফরকালে তিনি সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা ও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া বিজেপির সিনিয়র নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন তিনি।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে করা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও খুব ভালো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। অন্যন্য সব দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। শুধু এটুকু বলতে পারি যে ভারতের সব দল-মত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।”
সীমান্তে হতাহতের বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলাপ
২২ জুন ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ হাউজে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যদিকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
শেখ হাসিনা মঙ্গলবার তার লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তারা অন্যান্য পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং সীমান্তে হতাহতের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা ও পানি বণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
ভারতের গুরুত্বে বাংলাদেশ
শেখ হাসিনার মতে সফরকালীন সময়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককালে নরেন্দ্র মোদি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিবেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গভীরভাবে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ তাঁদের ‘প্রতিবেশী প্রথম’, ‘অ্যাক্ট ইস্ট’, ‘সমুদ্র ও ইন্দো-প্যাসিফিক’ নীতির কেন্দ্রে রয়েছে।
চীন-ভারতের তিস্তা প্রস্তাব
“দুটি প্রস্তাব বিবেচনা করে দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ। ভারত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পানির সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যাবে,” এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এই মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, “চীন-ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশ কখনও নাক গলায় না। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি আমি।”
ভারত-বাংলাদেশ নতুন চুক্তি
বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয় এবং তিনটি নবায়িত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয়। এছাড়া দুটি রূপকল্প ঘোষণা স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয়। বৈঠকে ভবিষ্যত কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ১৩টি যৌথ কার্যক্রমের ঘোষণা দেওয়া হয়।
যে ১০ চুক্তি:
১. বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ।
২. ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গ্রিন পার্টনারশিপ।
৩. সমুদ্র সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি।
৪. স্বাস্থ্য ও ওষুধসংক্রান্ত পুরোনো সমঝোতা নবায়ন।
৫. ভারতের ইন-স্পেস এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা।
৬. দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা।
৭. সমুদ্রবিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতা।
৮. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমনে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, বাংলাদেশ ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান সমঝোতা নবায়ন।
৯. মৎস্যম্পদের উন্নয়নে বিদ্যমান সমঝোতা নবায়ন।
১০. কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতায় ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ, ওয়েলিংটন-ইন্ডিয়া এবং মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের মধ্যে সমঝোতা।
এছাড়াও শেখ হাসিনা তার সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, রেল যোগাযোগ, সামুদ্রিক সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা, স্যাটেলাইট ও সামরিক শিক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। রেল যোগাযোগ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন শহরসহ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যাত্রী ও পণ্যবাহী রেলের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে সহযোগিতা, দুর্যোগ মোকাবিলা, সহনশীলতা ও প্রশমন এবং মৎস্যক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।
এই সফরে দুই দেশের মধ্যে গৃহীত কিছু কার্যক্রমের ঘোষণা দেওয়া হয়:
গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন ও বাংলাদেশের তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও পানি সংরক্ষণের প্রকল্পে ভারতের সহায়তার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি। তবে এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি না হওয়া তিস্তার পানি ভাগাভাগির কোন সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ই-ভিসা চালু ও রংপুরে ভারতের নতুন সহকারী হাই কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। এতে করে মুমূর্ষু রোগীদের ভিসা আগের চেয়ে দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ করা যাবে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করা যাবে।
রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস; চট্টগ্রাম ও কলকাতার মধ্যে নতুন বাস পরিষেবা চালু এবং গেদে-দর্শনা ও হলদিবাড়ি-চিলাহাটির মধ্যে দলগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালু। এতে করে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে।
অনুদান সহায়তার আওতায় সিরাজগঞ্জে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণ।
ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি, যার মাধ্যমে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সহযোগিতা আরও বাড়বে।
মুক্তিযোদ্ধা প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসা প্রত্যাশী রোগীদের জন্য খরচ সর্বোচ্চ সীমা ৮ লাখ টাকা করা এবং বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু।
‘ইউপিআই’-এর ব্যবহার শুরুর উদ্দেশ্যে দুই দেশ, বাংলাদেশে ‘রুপি’ কার্ড ও ভারতে ‘টাকা-পে’ কার্ড চালু।
এবারের সফরকালে ভারতের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নবনির্বাচিত দুটি সরকার কীভাবে সহযোগিতামূলক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে একটি রূপকল্প প্রণয়ন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এই সফর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।