অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের সহায়তায় আরও নেতিবাচক অবস্থানে গিয়েছে বাংলাদেশ। আর্থিক গোপনীয়তা সূচকে ১৪১ দেশের মধ্যে ৫২তম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের যেসব দেশ সহায়তা করছে তাদের অবস্থান শনাক্তে বৈশ্বিক এ র্যাঙ্কিং করা হয়। বছরে দুইবার এ সারণী সূচক প্রকাশ করে ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন)। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুসারে, দুই বছর আগের ৫৪তম স্থান থেকে এবার আরও দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয় যে, রাশিয়ার অভিজাতরা যেভাবে পেয়েছেন ঠিক সেভাবেই বিশ্বের অনেক দেশে করফাঁকি দাতা ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের জন্য গোপনীয়ভাবে আর্থিক সেবাদান কমেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কারণে। ফিন্যান্সিয়াল সিক্রেসি ইনডেক্স বা এফএসআই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৩২। একটি দেশের আইনি ব্যবস্থা অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের কতটুকু আর্থিক গোপনীয়তার সুযোগ করে দিয়েছে, সেটি এখানে হিসাব করা হয়েছে আইনি গোপনীয়তার স্কোর এবং বৈশ্বিক তুলনার পরিমাপকের সাহায্যে।
প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, বাংলাদেশ বিশ্বের আর্থিক খাতের মোট গোপনীয় সহায়তার শূন্য দশমিক ৬৮৪ শতাংশ দেয়। চলতি বছরে তালিকায় শীর্ষে এই সূচকের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে রেটিং নিয়ে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের মধ্যে এফএসআই সূচকে ভারতের অবস্থান ৩৬তম, শ্রীলঙ্কা ৫০, পাকিস্তান ৭৪ এবং মালদ্বীপ ৯১ তম হয়েছে।
গোপনীয়তার কারনে টাকা পাচার বাড়ছে
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) জানায়, সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা পাওয়ার কারণে সারা বিশ্বে বেসরকারি খাতের লোকজন এক দেশ থেকে অন্য দেশে এ পর্যন্ত ২১ থেকে ৩২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বা সম্পদ স্থানান্তর করেছে। বিপুল এই অর্থের বিপরীতে স্থানান্তরকারীরা কোনো রকম কর দেননি বা দিলেও তা নামমাত্র। সাধারণত ব্যাপক হারে কর ছাড় পাওয়ায় ও সিক্রেসি জুরিসিডকশনের আওতায়, অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে এমন শর্তেই মূলত বিশ্বজুড়ে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ অবৈধ উপায়ে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক দেশই সম্পূর্ণ কর ছাড় সুবিধা কিংবা নামমাত্র কর নিয়েই অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীদের এ সুযোগ দিয়ে থাকে। এসব দেশকে ট্যাক্স হ্যাভেন বা করস্বর্গ বলা হয়। এ জন্য বেশ কিছু দেশের নাম সুবিদিত।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধ অর্থ মানে কালোটাকা স্থানান্তরের পরিমাণ নেহাত কম নয়, তা ১ কোটি ট্রিলিয়ন থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ট্রিলিয়নের মতো হবে বলে অনুমান করা হয়। এ অর্থ সারা বিশ্বের এক বছরের বৈদেশিক সাহায্যের চেয়ে প্রায় ১২ গুণ বেশি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে ব্যাপকভাবে অবৈধ অর্থ স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ওই মহাদেশ থেকে মোট এক লাখ কোটি ডলারের সম্পদ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে। অথচ একই সময়ে আফ্রিকার সব কটি দেশ মিলে বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে ২০ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ আফ্রিকার দেশগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে, তার পাঁচ গুণ বেশি অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। একদিকে এসব দেশ বৈদেশিক ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছে, অন্যদিকে তাদের তথাকথিত ধনী বা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীরা বিদেশে সম্পদ পাচার করছে।
টাকা পাচারের চক্র গড়ে ওঠেছে
টিজেএনের মতে, গত শতকের আটের দশকে ফিন্যান্সিয়াল গ্লোবালাইেজশন বা অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত কর ফাঁকি দেওয়া এবং অবৈধ অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংক, আইনি ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষায়িত সেবা প্রদানকারী সংস্থার একটি চক্র গড়ে উঠেছে। আইনের ফাঁকফোকর গলে কীভাবে কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার করা যায় ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা যায়, তারা সেই সহযোগিতা দেয়। অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিক পরিমাণে অর্থ পাচারে আকৃষ্ট করতে বৈশ্বিক আর্থিক খাতে অবৈধ সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেন অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলে।