ছবি: সংগৃহীত
২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির আয়করে আসছে বড় ধরনের পরিবর্তন। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলেও কর-স্ল্যাব ও হার পুনর্বিন্যাসের ফলে বিপাকে পড়তে পারেন নিয়মিত করদাতা, বিশেষত মধ্যবিত্তরা। প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, সীমিত আয়ের মানুষের জন্য করের বোঝা বাড়তে পারে, যা অনেকের চোখে ‘অদৃশ্য শাস্তি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সোমবার, ২ জুন জাতির উদ্দেশে বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব প্রস্তাব তুলে ধরবেন। প্রস্তাবে একদিকে যেমন খাদ্য, প্রযুক্তি ও গণপরিবহনে কিছু স্বস্তির বার্তা আছে, তেমনি বিলাসপণ্য ও খেলনার মতো পণ্যে বাড়তি ব্যয়ও আশঙ্কিত হচ্ছে।
কর কাঠামোয় পরিবর্তনের চিত্র
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রস্তাবিত কাঠামোয় সাধারণ করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ দশমিক ৭৫ লাখ টাকা নির্ধারণের চিন্তা করছে। নারী, জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এই সীমা ৪ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বড় ধাক্কা আসছে স্ল্যাব কাঠামোয়।
প্রথম স্তরের ৫ শতাংশ করহার তুলে দিয়ে সরাসরি ১০ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব রয়েছে। ফলে বর্তমানে ৪ দশমিক ৫ লাখ টাকা আয়ে কর দাঁড়ায় ৫ হাজার টাকা, সেখানে নতুন কাঠামোয় তা বেড়ে হবে ৭,৫০০ টাকা—যা এক লাফে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি মূলত কর-নিষ্ঠ মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়াবে।
এই পরিবর্তন নিয়মিত করদাতাদের জন্য আর্থিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন তারা। সরকারের উচিত করজাল সম্প্রসারণ, কেবল বিদ্যমান করদাতাদের ওপর বোঝা চাপানো নয়।
বর্তমানে ১ কোটি ১৫ লাখ টিআইএনধারীর মধ্যে কর দেন মাত্র ১৫ লাখ—বাকি বেশিরভাগই আয় শূন্য দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করেন।
নতুন কর স্ল্যাবের খসড়া (ব্যক্তি শ্রেণি)
· ৩ দশমিক ৭৫ লাখ পর্যন্ত: করমুক্ত
· পরবর্তী ৩ লাখ: ১০%
· পরবর্তী ৪ লাখ: ১৫%
· পরবর্তী ৫ লাখ: ২০%
· ২০ লাখ টাকার ওপরে: ২৫%
· ৩৫ দশমিক ৭৫ লাখ টাকার ওপরে: ৩০% (আগে কার্যকর হতো ৩৮ লাখে)
এলইডি বাতি, পোকা দমন, খেলনায়ও খরচ বাড়তে পারে
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি বাতি ব্যবহারে মধ্যবিত্তকে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। কারণ এই বাতি তৈরির উপকরণে বসানো হয়েছে ১০ শতাংশ বাড়তি কাস্টমস শুল্ক। খেলনা আমদানিতে এখন ন্যূনতম মূল্য হিসেবে প্রতি কেজিতে ০.৫০ ডলার থেকে বাড়ানোর প্রস্তাবে শিশুকে খেলনা কিনে দিতেও লাগবে বাড়তি অর্থ। মশা-মাছি-তেলাপোকার উপদ্রব থেকে বাঁচাতে হলেও গুনতে হবে অতিরিক্ত টাকা। কীটপতঙ্গ মারার উপকরণ আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
গৃহস্থালি পণ্যের বাড়ছে ভ্যাটের চাপ
প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, টয়লেট্রিজ, এলপিজি সিলিন্ডার, লিফট, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ও কমপ্রেসর উৎপাদনকারী শিল্পে বড় অঙ্কের কর বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি নির্মাণ খাত ও রড তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের ওপরও কর বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। এই খাতের বেশ কিছু দরকারি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে। যেমন—সিমেন্ট, রড, বার, অ্যাঙ্গেল, টাইলস, স্ক্রু, নাট-বোল্ট ও নির্মাণ-সামগ্রীর দাম আকাশ ছুঁতে পারে। এতে মধ্যবিত্তকে জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে শেষ জীবনে বাড়ি বানানোর স্বপ্নও ফিকে হবে।
নগর জীবনে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ছে। রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার ও কম্প্রেসরের ভ্যাট এক লাফে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। আগে ৭.৫০ শতাংশ থাকলেও এখন ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনের বিভিন্ন উপকরণের ক্ষেত্রেও ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্য যেমন : ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার এবং প্রেসার কুকারে এ পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। এ জন্য দামও সহনীয় ছিল। তবে আসছে বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হতে পারে। রান্নার কাজে ব্যবহৃত এলপিজি সিলিন্ডারের ভ্যাট হার বেড়ে ১০ শতাংশ হচ্ছে।
কিছু সুখবর
তবে কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তিও আছে, যেমন আবগারি শুল্কের সীমা বাড়িয়ে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে, ফলে সাধারণ আমানতকারীরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার নিয়ম আরও সহজ করতে যাচ্ছে সরকার। এতে স্বস্তি পাবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ কোটির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মধ্যে ১৫ দশমিক ৫ কোটিরই জমা তিন লাখ টাকার কম।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও কৃষিপণ্যের আমদানিতে স্থানীয় ঋণপত্রের (এলসি) কমিশনের ওপর উৎস কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর আওতায় পড়বে চাল, ডাল, ধান, গম, পেঁয়াজ, আলু, চিনি, ভোজ্যতেলসহ ২৫টির বেশি খাদ্যপণ্য। এ ছাড়া কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ফলমূল আমদানির ওপর কর হ্রাসের মাধ্যমে ভোক্তাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অপ্রদর্শিত আয়ের বৈধতা: জমি-বাড়ি বিক্রিতে ১৫% কর দিয়ে সুযোগ
জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির সময় দলিলে প্রকৃত মূল্য কম দেখিয়ে অতিরিক্ত লেনদেন একটি পুরনো সমস্যা। এবার সেটিকে কাঠামোগতভাবে আনতে প্রস্তাব করা হয়েছে, দলিল-বহির্ভূত অতিরিক্ত অর্থ ১৫% কর দিয়ে বৈধ করা যাবে, এমনকি গত পাঁচ বছরের ক্ষেত্রেও। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তবে বাস্তবায়নে বিভাগীয় সমন্বয় জরুরি।
খাতভিত্তিক কর নীতিতে বৈচিত্র্য
মোবাইল কোম্পানি: তালিকাভুক্ত মোবাইল অপারেটরের করহার ৪৫% থেকে কমিয়ে ৪০% করা হচ্ছে।
সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য: অগ্রিম কর বাড়ছে ৩% থেকে ৫%। আমদানিকৃত সিগারেট পেপারে সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করে ৩০০% করা হচ্ছে।
রিটার্ন বাধ্যতামূলকতা ও ন্যূনতম কর
আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক সেবার সংখ্যা ৪৫ থেকে কমিয়ে ৩৯ করা হলেও, নতুনভাবে ১২টি সেবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে টিআইএন জমার বিধান আসছে। অনলাইনে রিটার্ন দাখিলও বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, এবং করযোগ্য আয় না থাকলেও এক হাজার টাকা ন্যূনতম কর আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
শেয়ারবাজারে কিছু ছাড়
শেয়ারবাজারে উৎসে কর ০.০৫% থেকে কমিয়ে ০.০৩%।
মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭.৫% থেকে কমিয়ে ২৭.৫%।
ব্যাংকিং চ্যানেলে পুরো আয় গ্রহণকারী কোম্পানির করহার ২০% পর্যন্ত কমতে পারে।
অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে শুল্ক বৃদ্ধি
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা খাতে শৃঙ্খলা আনতে চালক মোটরের শুল্ক এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের মতে, এটি অবৈধ উৎপাদন ও পরিবেশঝুঁকি রোধে সহায়ক হবে।
বাজেটের বার্তা দ্বিমুখী
বাজেটের প্রস্তাবিত কাঠামো একদিকে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী, উৎপাদন খাত ও নির্দিষ্ট কিছু ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে, অপরদিকে মধ্যবিত্ত করদাতাদের জন্য বাড়তি চাপের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, করজাল সম্প্রসারণ না করে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর নির্ভরতা বজায় থাকলে তা আখেরে দীর্ঘমেয়াদে করনীতিকে আরও সংকুচিত ও বৈষম্যমূলক করে তুলতে পারে।