অনলাইন মার্কেটপ্লেস ইভ্যালির বিরুদ্ধে যত দ্রুতসম্ভব আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে ই-কমার্স বিষয়ক জাতীয় কমিটি। আর সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়েও প্রতিশ্রুত সময়ে পণ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ রয়েছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চাইলে তার জবাবেও ইভ্যালির দেওয়া তথ্যে গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠক শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান এ তথ্য জানান।
ইভ্যালি ইস্যুতে সময় দেয়া হবে না
হাফিজুর রহমান বলেন, ইভ্যালি ইস্যুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর সময় নিতে চায় না। এ বিষয়ে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হবে। আজকের (মঙ্গলবার) সভায় সর্বসম্মতভাবে পর্যালোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার ধরন হিসেবে কী তথ্য উঠে এসেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর বলেন, তারা গ্রাহকের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ পর্যন্ত পণ্য দেয়নি। এটি একটি প্রতারণা। মার্চেন্টের পাওনাও তারা পরিশোধ করেনি। তাছাড়া তিন দফায় মন্ত্রণালয় ইভ্যালির কাছ থেকে আর্থিক বিবরণী সংক্রান্ত যে তথ্য চেয়েছে, তার জবাব তারা দিয়েছে। কিন্তু ইভ্যালির দেওয়া জবাবের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা তথ্য-উপাত্তের গরমিল রয়েছে। তারা ভুল তথ্য দিয়েছে। এটিও এক ধরনের প্রতারণা।
আইনি পদক্ষেপের উদ্যোগ
আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইভ্যালির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হলে গ্রাহকের পাওনা উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি কী হবে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপে যেতেই হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক ভোক্তা অধিকার আইনে মামলা করতে পারবেন। সংক্ষুব্ধরা ফৌজদারি আইনেও যেকোনো থানায় মামলা করতে পারবেন ইভ্যালির বিরুদ্ধে।
এর আগে, গত ১২ সেপ্টেম্বর ইভ্যালিসহ ১০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পৃথক নিরীক্ষা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— ই-অরেঞ্জ সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিড ডটকম ডটবিডি ও আলেশা মার্ট। এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ইভ্যালি ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপের দিকে যাওয়া হবে। এরপর বিতর্কিত বাকি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তৃতীয় পক্ষ অডিটর নিয়োগের এখতিয়ার নেই
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে থার্ড-পার্টি অডিটর নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডাব্লিউটিও সেলের এই মহাপরিচালক বলেন, ই-কমার্স সংক্রান্ত কমিটি মতামত দিয়ে বলেছে— থার্ড-পার্টি অডিটর নিয়োগের এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। কারণ মন্ত্রণালয় থেকে সব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন বা ব্যবসায়িক লাইসেন্স নেয়নি। তবে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় সরকার অনেক কিছুই সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় তার আইনি এখতিয়ার আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি নিয়ে থার্ড-পার্টি অডিটর দিয়ে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আর্থিক চিত্র বের করে আনা হবে।
বৈঠকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত ব্যবসাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব নিজের মতামত তুলে ধরে বলেন, ইভ্যালি ইস্যুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আর দায়িত্ব নেওয়া উচিত হবে না। ইভ্যালিকে বর্তমান ধারায় চলতে দিলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। তাই সময় নষ্ট না করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। মো. হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, আরজেএসসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ই-ক্যাব প্রতিনিধি।
২০১৮ সালে ইভ্যালির যাত্রা
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা ইভ্যালি আকর্ষণীয় সব অফার দিয়ে বাজিমাত করতে থাকে। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অফারের ঘোষণা অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ না করা ও রিফান্ড নিয়ে অনিয়মসহ বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে ক্রেতাদের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে ইভ্যালি নিয়ে বলা হয়েছে, এ বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৪ কোটি টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি। আবার মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ১৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ইভ্যালির চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। ইভ্যালির প্রকৃত দায়-দেনার পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইভ্যালি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ইভ্যালির কাছে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তও চেয়ে পাঠায়। একাধিকবার সময় নিয়ে জমা দেওয়া সেসব হিসাবে ইভ্যালি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলছে, তাদের কাছে পাওনার পরিমাণ ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। যদিও ইভ্যালি নিজেই জানিয়েছিল, ১৫ জুলাই পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট দায় ছিল ৫৪৪ কোটি টাকা। তাদের স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকা। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা অদৃশ্যমান সম্পত্তি। ওই সময় পর্যন্ত সম্পদ ও দায়ের হিসাব অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে মোট ৩১০ কোটি ৯৯ লাখ ১৩ হাজার ৪০৭ টাকার দায় রয়েছে বলে জানায় ইভ্যালি।