কোনো দেশের উচ্চশিক্ষালয় এবং তার আবাসিক হলগুলো হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একধরনের আশীর্বাদ। এসব ছাত্রাবাস ও হলে থাকতে পারা শিক্ষার্থীদের জন্য একটা সৌভাগ্যের বিষয়। পড়ালেখা এবং থাকা–খাওয়ার একটা কম খরচের বন্দোবস্ত। এসব হল ও ছাত্রাবাস যদি হয় আশির্বাদ, তাহলে এর বিপরীতটাই হচ্ছে র্যাগিং ও গেস্টরুম কালচার।
হলে তৈরি করা বিশেষ টর্চার সেল, শ্রেণিকক্ষ, থাকার হল, খাওয়ার ক্যান্টিন এবং কখনো কখনো পাঠকক্ষেও হয়রানির শিকার হন পড়ুয়ারা। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার-এমন শিক্ষার্থীদের অনেকেই হল ছেড়ে মেসে উঠেন। কেউ আবার বাধ্য হন ক্যাম্পাস ছাড়তে। নির্যাতনে বিকলাঙ্গ হওয়া এবং প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে অহরহ।
‘র্যাগিং’ বর্তমান সমাজে একটি ভীষণ প্রচলিত শব্দ। সিনিয়রদের দ্বারা নবাগত শিক্ষার্থীদের শারিরীক ও মানসিকভাবে নিগ্রহ করার এক নির্মম প্রক্রিয়া। এর বলি হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার পার্ট চুকে যায়, অনেককে আবার বিসর্জন দিতে হয় তার একমাত্র প্রাণটিও। বুয়েটছাত্র আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ড অতিসাম্প্রতিক এক উদাহরন।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে র্যাগিং অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং এর জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। র্যাগিং বন্ধে ২০২০ সালে হাইকোর্ট প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড গঠনের নির্দেশনা দিলেও, এখনও পর্যন্ত নেই তার উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন।
র্যাগিংয়ের ধরন
র্যাগিংয়ে নবীনদের শেখানো হয় কীভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে হয়, বড়দের সালাম-সম্মান দিতে হয়, দাঁড়াতে হয়, হাসতে হয় ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে এসব ভালো শোনা গেলেও বাস্তবে ভিন্নতাই বেশি। এক পায়ে দাঁড় করানো, জানালার সঙ্গে ঝুলে থাকা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে কক্ষ পরিমাপ, চায়ের চামচ দিয়ে পানিভর্তি বালতি খালি করা, এক হাতে বৈদ্যুতিক বাতি আর অন্য হাতে পানির ট্যাপ ঘোরানোর মতো করে নৃত্য করা—এগুলো ‘র্যাগারদের’ কাছে র্যাগিংয়ের সাধারণ ও সেকেলে ঘটনা।
এর বাইরেও ‘বড় ভাইয়েরা’ নিজেরাও আদব শিখিয়ে থাকেন নবীনদের। এর মধ্যে চড়থাপ্পড়, লাঠি-রড পেটার ঘটনাও ঘটে। মজার বিষয় হল, এই বড়ভাইদের নিজেদেরই নেই আদবকায়দা। তারাই শেখান নবীনদের।
অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াডের অগ্রগতি কতদূর
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াডের অগ্রগতি সম্পর্কে দ্য রিপোর্টকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক ড. জামিনুর রহমান বলেন, অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড গঠন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তাদের কোনরূপ যোগাযোগ এখনও পর্যন্ত হয়নি।
এর আগে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল কলেজগুলোতে র্যাগিং ও বুলিয়িং এর কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক অসুস্থতাসহ মৃত্যুর খবরও প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। ২০২১ সালে একইভাবে অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা সারাদেশে আলোচিত হয়।
এর আগেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রমবৃদ্ধিমান এই র্যাগিং এর ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজ। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে নীতিমালা তৈরি, র্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন ও তদারকির জন্য অ্যান্টি র্যাগিং স্কোয়াড গঠন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী আইনি রিট করেন।
দায়ের করা রিটের রায়ে সুপ্রীম কোর্ট ২০২০ সালে তিন মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন ঠেকাতে কমিটি ও স্কোয়াড গঠনের আদেশ দিলেও, এখনও পর্যন্ত তার উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, কেবল হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
র্যাগিং বন্ধে ২০২০ সালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, সরকারের একার পক্ষে র্যাগিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সামাজিক আন্দোলনেরও প্রয়োজন। কিন্তু সমাজ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, বিভক্ত একটি সমাজে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে র্যাগিংয়ের মতো সংকট মোকাবিলা করা সহজ নয়।
র্যাগিং ও নারী নিগ্রহের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলো প্রতিরোধে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর স্থানীয়ভাবে শ্রদ্ধাভাজন নেতারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধেই শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। ফলত, র্যাগিং বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিকার তেমন সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে সরকার-শিক্ষামন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ জানার জন্য একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে কল করলেও, তিনি সাড়া দেননি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং ও বুলিয়িং বন্ধ করার জন্য বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে ‘শিক্ষা আইন-২০১’ এর চূড়ান্ত খসড়ায়। ২০২১ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল বৈঠকে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এ আইন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে নিজেরাই নীতিমালা বা নির্দেশিকা জারি করবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর নীতিমালা বা নির্দেশিকা জারি করবে।
তবে খসড়া চূড়ান্তকরণের এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও, শিক্ষা আইনটি পাস করার ব্যাপারে কোন অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত হয়নি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, আইনটির খসড়া চূড়ান্তকরণ হয়ে মন্ত্রীপরিষদে গেলেও, সেখান থেকে এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা আসেনি। এদিকে প্রচলিত আইনে নির্দিষ্টভাবে র্যাগিংবিরোধী কোনো বিধান না থাকায়, র্যাগিং বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।