করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটির এক বছর পূরণ হলো আজ। গত বছরের এইদিনে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ওইদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন তিনি। এরপর দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে এখনও চলছে সেই ছুটি।
গত বছর জুন থেকে আস্তে আস্তে সব কিছু খুলে দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল থাকে সরকার। তবে বন্ধের এ সময় অনলাইন, সংসদ টিভি, বেতারসহ বিভিন্ন ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ক্লাস চলমান ছিলো।
মাঝে সংক্রমণ কমে আসায় আগামী ৩০ মার্চ থেকে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। কিন্তু ইতোমধ্যে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় সেই তারিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখে দিয়েছে।
নতুন করে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের ঊর্ধ্বগতির কারণে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করেছে। তবে ঘোষিত তারিখের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সব ধরনের প্রস্ততি শেষ করতে তোড়জোড় চালাচ্ছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত এক বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না হতে পারাটা ছিলো শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর জন্য বিভিন্ন জটিলতার উদ্ভব হয়েছে এবং এর সামাজিক ও একাডেমিক নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী; যা ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীকে মোকাবিলা করতে হবে।
অন্যদিকে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অটোপ্রমোশন দিতে হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিখন-পঠনে ঘাটতি নিয়েই পরবর্তী উচ্চতর শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। এতে তাদের শিখনের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে; যা পরবর্তী শ্রেণিতে শিখনে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।
সব মিলে সারা দেশে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বড়দের চেয়ে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে শিশুদের। কারণ, শিশু শ্রেণিতে ‘লার্নিং-এবিলিটি’ (শিখন সক্ষমতা) অর্জন না হওয়ায় তারা পুরো একটি বছর পিছিয়েই থাকবে।
দীর্ঘ ছুটির কারণে এ বছর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, মহারমারি শেষ হলে বিশ্বে প্রায় ১ কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরবে না। বাংলাদেশেও এর প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। উল্লেখ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত তাদের বিদ্যালয়ে নাম তালিকাভুক্ত করেনি বা ভর্তি হয়নি।
একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। কারণ, এসব শিশুর পরিবার আর্থিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ায় তারা এখন আয়-রোজগারের কাজে পিতা-মাতার সহযোগিতায় নেমেছে, যদিও এখন পর্যন্ত এর কোনো জরিপ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তবে মেয়েশিশুদের বেলায় ঘটেছে বাল্যবিবাহের ঘটনা। এমনিতেই বাল্যবিবাহের ঘটনায় বাংলাদেশে অবস্থান চতুর্থ।
ফলে এরা হয়তো বা আর কখনো স্কুলে ফিরে আসবে না। করোনাকালে সরাসরি শ্রেণি পাঠদান বন্ধ থাকলেও শহরাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চালু রেখেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে এ সংখ্যা খুবই কম ছিলো।
‘ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন’ (সিএএমপিই)-এর ২০২০-২১-এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এ দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেনি।
অর্থাৎ যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বাকি ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে বা ‘লার্নিং গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে।
এ সময়ে অনেক শিশু-কিশোর ‘স্মার্টফোন অ্যাপস’-এ আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকের বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে ‘স্মার্টফোন’-এ সময় দেওয়ার জন্য।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থায় বন্ধ থাকায় দেশের অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন স্কুল অচল হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষক পেশা বদল করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়ে দিন গুজরান করছেন।
ফলে সামনে কয়েক মাসের মধ্যে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রাথমিকের প্রায় পৌনে দুই কোটির শিক্ষার্থীর সবাই স্কুলে স্থান পাবে না। কারণ, আর্থিক কারণে অনেক কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুব সহসাই চালু করা সম্ভব হবে না।
করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বিপর্যয় নেমে এসেছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ আঘাত এসেছে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে।