স্থাপত্যপ্রেমীদের কাছে মেরিনা তাবাসসুম নামটি অতিপরিচিত। অনবদ্য ও নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম দিয়ে আগেই তিনি এ দেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। এবার জয় করছেন জার্মানির মানুষদের। জার্মানির মিউনিখে ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে তাঁর স্থাপত্য প্রদর্শনীটি। এরইমধ্যে তাঁর কাজ দেখেছেন প্রায় ২৫ হাজার দর্শক। এ প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত। মেরিনার স্থাপত্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে জার্মান দর্শক চিনছে বাংলাদেশকে।
মিউনিখে পিনাকোথেক ডার মডার্ন মিউজিয়াম। দূর থেকেই দৃষ্টিগোচর হয় কাচের দেয়ালে জ্বলজ্বল করা একটি বিশাল পোস্টার! শিরোনাম ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস: ইন বাংলাদেশ৷' এ যেন একখণ্ড বাংলাদেশ! দর্শক ঘুরে ফিরে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখছেন মেরিনা তাবাসসুমের সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞ৷ তার স্থাপত্যগুলোর মধ্যে স্থানান্তরযোগ্য বাড়ি ‘মুন্সিগঞ্জ-দোহার-বিক্রমপুর' আলাদা দৃষ্টি কেড়েছে দর্শকের। জাদুঘরের প্রবেশমুখে শোভা পাচ্ছে আস্ত বাড়িটি।
মেরিনার চিন্তাশীল কর্মে উপাদান থাকে বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রকৃতি, জলবায়ু এবং সংস্কৃতি৷ কাজের মধ্যে অনুসন্ধানমূলক প্রক্রিয়ার ব্যবহারের জন্য তাঁকে সমকালীন সেরা স্থপতিদের একজন মনে করা হয়। চরের মানুষের জন্য তৈরি প্রমাণ সাইজের স্থানান্তরযোগ্য এ বাড়ির নকশা তৈরি হয় বাঁশ আর ইস্পাত দিয়ে। রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি জনপরিসর বা কমিউনিটি স্পেসের নমুনা প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য।
মিউনিখের স্থানীয় পত্রিকাগুলোর খবরে জানা গেছে, তাঁর স্থানান্তরযোগ্য বাড়ি তৈরির একটি ইতিহাস। বেশ কয়েক বছর আগে চর ও চরের মানুষদের নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন মেরিনা। সে গবেষণার ভিত্তিতে দোহারে তৈরি এ রকম তিনটি বাড়ির নকশা ২০১৯ সালে শারজা বিয়েনালে প্রথম স্থান পায়। চরের মানুষের কথা ভেবে ‘খুদে বাড়ি'র (ছোট বাড়ি) নকশা করেন মেরিনা। করোনার বিধিনিষেধে প্রথম এর নমুনা তৈরি করেছিলেন ঢাকায়। যমুনার চর হিজলায় পরপর আরও চারটি তৈরি করেছেন। সেগুলোও প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
প্রদর্শনীটি আয়োজন করতে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর। মেরিনা ১৯৯৫ সালে স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সাথে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরবানা। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস'। ২৮ বছরের কর্মযাত্রায় মেরিনা সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য স্থাপত্য। তাঁর উদ্ভাবন থেকে বাছাই করা নকশা নিয়ে তিন কক্ষজুড়ে চলছে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী। এটি ছবি, অডিও–ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা আর বিরাটকায় বা ক্ষুদ্রাকার বিচিত্র স্থাপনা দিয়ে সাজানো হয়েছে।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ২০১৬ সালে আগা খান পুরস্কার পাওয়া ঢাকার দক্ষিণ খানের বায়তুরক; রউফ মসজিদ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য নির্মিত বাড়িসহ শহরতলি আর শহরের শতাধিক নকশা। তাঁর এই প্রদর্শনী দর্শকদের কাছে অর্থবহভাবে তুলে ধরতে কিউরেট করেছেন জার্মানির স্থাপত্য–ইতিহাসবিদ ভেরা সিমোন বাডের।
মেরিনা ২০২০ সালে এই জাদুঘরে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁর কাছে জাদুঘরের পরিচালক একটি প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেন। করোনাকালে তা সম্ভব হয়নি। যদিও করোনা চলাকালে তিনি অনন্য এক সম্মাননা পেয়েছেন। টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ তাঁকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। এই প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে ডক্টরেট উপাধির অভিজ্ঞানপত্রও তুলে দেওয়া হয়।
১১ জুন মিউনিখে প্রদর্শনী সমাপ্ত হলে এটি যাবে হল্যান্ডের রটারডামে। তারপর যাবে পর্তুগালের লিসবনে। মেরিনা তাঁর প্রদর্শনীটি লন্ডন, নিউইয়র্কসহ আরও কয়েকটি শহরে নিয়ে যেতে চান।
প্রসঙ্গত, মেরিনা তাবাসসুম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পুরস্কার (১৯৯৭), ভারতে সেরা স্থপতি পুরস্কার (২০০১), আর্নল্ড ডব্লিউ ব্রুনার মেমোরিয়াল প্রাইজ (২০২১), পুর্তগালে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ (২০২২) বেশ কয়েকটি সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন।