দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। কিন্তু সেই তুলনায় মানসিক রোগের চিকিৎসার পরিমান খুবই কম। আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জপিরে দেশের ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর চরম পরিণতি হিসেবে আত্মহত্যা, ভবঘুরে হয়ে যাওয়ার পরিমান বাড়ছে। তবে রোগীদের মাত্র ৮ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
মানসিক চাপে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা
করোনাকালে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৮৪ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ সময় গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। মানসিক সমস্যা বেশি হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের। বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে।
‘করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয়’ শিরোনামে জরিপটি করেছে তারা। গত ১২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পরিচালিত জরিপে সারা দেশের ৯২টি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ৫৫২ শিক্ষার্থীর বক্তব্য নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬১ শতাংশ নারী। তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন ১ জন। শিক্ষার্থীদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৮ বছর। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সী। জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতাসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
চিকিৎসা নিচ্ছে মাত্র ৮ শতাংশ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক হিসাব বলছে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ৯২ শতাংশ মানুষই কোন ধরনের সেবা বা পরামর্শ নেন না। বাকি মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ মূল ধারার চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর সেখানে শুধু মানসিক রোগের চিকিৎসক নন বরং অন্যান্য চিকিৎসকও রয়েছেন।
আর যারা চিকিৎসা নিতে যান তারাও সমস্যা দেখা দেয়ার প্রথম দিকে নয় বরং একেবারে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
করোনাকালীন সময়ে সারাদেশের মানসিক রোগ পরিস্থিতির জন্য আইইডিসিআর একটি জরিপ চালায়। জরিপ অনুসারে আইইডিসিআর বলছে, কোভিড মহামারীর সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুঃশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরা চাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জহির উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, কোভিডের কারণে মানুষের মাঝে মানসিক বিষন্নতা ও ভয় বেড়ে গেছে। আমাদের এখানে মানুষ বিষন্নতা, একাকীত্ব, একবার কোভিডে আক্রান্ত হলে আবার আক্রান্ত হওয়ার মৃত্যুভয়, শুচিবায়ু বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসওর্ডার নিয়ে আমাদের কাছে বেশি এসেছে।
বাড়তি চাপ না দেয়ার আহ্বান
অনেক দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থবির থাকায় পাঠ্যক্রম দ্রুত শেষ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে জানায় বিশেষজ্ঞরা।
আমাদের অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে দেড় বছরের পড়াশোনা দেড় মাসে করিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে হিতে বিপরীত হবে বলে জানায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলালুদ্দীন আহমদ।
এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, শুরুতে কিছুদিন পাঠ্য বিষয়ের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক কাজে অংশ নিতে দিতে হবে বলে জানান তিনি।
আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়ছে
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব, করোনায় মৃত্যুভয়, সেশনজট ও বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ির মতো বিষয় স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে আমাদের জরিপে উঠে এসেছে। এ সময়ে আত্মহত্যার পরিমানও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বেসরকারি কোনো কোনো সংস্থার মতে এসময়টাতে অন্য সময়ের তুলনায় ৪৪ থেকে ৪৫ শতাংশ আত্মহত্যা বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন আত্মহত্যা করে। ব্যুরোর এর আগের বছরের হিসাবে অর্থাৎ ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করে। সরকারের হিসাবে করোনাকালে ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে ।