দেশে মানসিক রোগ বাড়ছে লাগামহীন হারে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১, ০৪:৩০ পিএম

দেশে মানসিক রোগ বাড়ছে লাগামহীন হারে

করোনা মহামারীতে সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্বের মতো বিভিন্ন কারণে মানসিক সমস্যা বেড়েছে। আর এই মানসিক সমস্যার প্রভাবে বেড়েছে আত্মহত্যার পরিমানও। সেই সাথে কমেছে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতাও। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপুর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে তিনি বিষন্নতায় ভুগছিলেন।

বিষন্নতায় ও মানসিক চাপে শিক্ষার্থীরা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর করা এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়েছে। ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের উদ্বিগ্নতা বেড়েছে, আর অন্তত ৪৭ ভাগের মধ্যে বিষন্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এছাড়া শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের মধ্যে সমসাময়িক পরিস্থিতির নিয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতির আগের চেয়ে পরে মানসিক সমস্যা চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপু। ছবি: সংগৃহীত

আত্মহত্যা বেড়েছে ৪৪ শতাংশ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বেসরকারি কোনো কোনো সংস্থার মতে এসময়টাতে অন্য সময়ের তুলনায় ৪৪ থেকে ৪৫ শতাংশ আত্মহত্যা বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন আত্মহত্যা করে। ব্যুরোর এর আগের বছরের হিসাবে অর্থাৎ ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করে। সরকারের হিসাবে করোনাকালে ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে ।

এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাভাবিক সময় যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায় না বা কম থাকে এসময় তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী করোনাকালে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে ছিল। এসময় ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের আত্মহত্যার তথ্য আমাদের কাছে আসে। শিশুদের স্কুল বন্ধ থাকায় তারা মানসিক চাপে পড়ে।

আত্মহত্যা বেশি নারীদের

সারা দেশে করোনাকালে পুরুষের চেয়ে বেশি নারী আত্মহত্যা করেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ। মোট আত্মহত্যার ঘটনা ১৪ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ৮ হাজার ২২৮টি।

লকডাউনে শিশুরা ভয়ানকভাবে অসামাজিক হয়ে গেছে। ছবি: সংগৃহীত

শিশুরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জহির উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, লকডাউনে শিশুরা ভয়ানকভাবে অসামাজিক হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলতে চায়না, খারাপ ব্যবহার করে। তাদের মানসিক অবস্থা একদম ভাল নেই। সারাদিন এক টিভি নাহলে মোবাইলের ওপর নির্ভরশীল। এতে করে তাদের মানসিক ভারসাম্য ব্যহত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহুর্তে লকডাউনের কারণে আমাদের রোগীর সংখ্যা কম। তবে, সাধারণত আমাদের রোগীদের চাপ অনেক বেশি থাকে। কোভিডের কারণে মানুষের মাঝে মানসিক বিষন্নতা ও ভয় বেড়ে গেছে। আমাদের এখানে মানুষ বিষন্নতা, একাকীত্ব, একবার কোভিডে আক্রান্ত হলে আবার আক্রান্ত হওয়ার মৃত্যুভয়, শুচিবায়ু বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসওর্ডার নিয়ে আমাদের কাছে বেশি এসেছে।

স্বাস্থ্যকর্মীরাও মানসিক চাপে

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপের ফলাফল তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছয় দশমিক সাত শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা এবং চার দশমিক সাত শতাংশ মানুষে ভুগেছেন দুঃশ্চিন্তায়। আইইডিসিআর বলছে, কোভিড মহামারীর সময় বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষন্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুঃশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরা চাপ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।বেগম রোকেয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক অনলাইন গবেষণায় দেখা গেছে, এ সময়ে ৭১ শতাংশ মানুষের মধ্যে ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা মানসিক চাপের শহর

২০১৭ সালে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যিপজেটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এএশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা সবচেয়ে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের শহর।

গবেষণায় বায়ু দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, লিঙ্গ বৈষম্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের মত বিষয়ের মানদণ্ডে বিশ্বের ১৫০টি শহরের তালিকা করা হয়েছে।

কিন্তু ঢাকাবাসী মানুষের মানসিক চাপ কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষের যেমন কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়, তেমনি বেসরকারিভাবেও তেমন কোন উদ্যোগ নেই।

Link copied!