সারা বিশ্বের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন প্যানডোরা পেপার্স। উইকিলিকস, পানামা পেপার্স আর প্যারাডাইস পেপার্সের ধারাবাহিকতায় আবারো পৃথিবীর সামনে ‘প্যানডোরা পেপার্স’ নামে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী কয়েক ডজনব্যক্তির গোপন সম্পদ ও তথ্য প্রকাশ করেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে। বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, ধনী ব্যক্তি ও বিভিন্ন অঙ্গণের তারকার নাম রয়েছে এই তলিকায়।
প্যানডোরা পেপার্সের ফাঁস হওয়া নথির নাম রাখা হয়েছে গ্রিক পুরাণের প্যানডোরা নামের এক নারীর নামানুসারে। চলুন জেনে নেওয়া যাক প্যানডোরার সেই মজার গল্পটি:
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী প্যানডোরা ছিলেন দেবতাদের তৈরি পৃথিবীর প্রথম নারী। অলিম্পাসের দেবতারা টাইটানদের কাছ থেকে স্বর্গ ছিনিয়ে নেওয়ার পরে পৃথিবীতে নতুন প্রাণী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়। সে দায়িত্ব দেওয়া হয় এপিমেথেউস ও প্রমিথিউস নামের দুই ভাইকে।
এপিমেথেউস পৃথিবীতে নতুন প্রানীর সৃষ্টি করে এবং স্বর্গীয় সকল ভালো গুণগুলো দিয়ে তাদের মহিমাম্বিত করেন। মানুষ তখন সুখেই বসবাস করছিলো। সুখ মানে নিজেদের মাঝে মারামারি ছিলো না, যুদ্ধ ছিলো না, হিংসা ছিলো না, বিদ্বেষ ছিলো না, কাম ছিলো না। তারা ছিলো সব পুরুষ। কারণ, তখনো নারী তৈরি হয় নি। একসাথে মিলেমিশে বাস করতো তারা। তাদের অভাব ছিলো না।
কিন্তু তারা কষ্ট পেতো শীতে। কেননা তখন আগুন ছিলো না। খেতে হতো কাঁচা মাছ-মাংস। দেবতাদের মাঝে প্রমেথিউস ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। আহা! ভালো ভালো মানুষগুলো কী কষ্টেই না আছে! ভাবলেন তিনি। বললেন, ওদের আগুন দিয়ে দেয়া হোক। আগুন পেলেই ওরা উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে।
দেবতা জিউস বললেন, রাখো! ওরা আগুন পেলে অপব্যবহার করবে। আগুনের সৌন্দর্যে ওরা নিজেরাই নিজেদের পুড়িয়ে মারবে। কিন্তু প্রমেথিউসের বিশ্বাস মানুষ এমনটা কখনোই করবে না।
এসময় প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনে মরনশীল মানুষের হাতে তুলে দেন। আগুন চুরি করায় দেবরাজ জিউস প্রমিথিউস ও মানব জাতির উপর রেগে গিয়ে তাদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি শাস্তি দিলেন প্রমেথিউসকে। বেঁধে রাখলেন শেকল দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায়। যেন শকুন এসে প্রমেথিউসের শরীরের মাংস ঠুকরে ঠুকরে খেতে পারে।
প্রমেথিউসকে তো শাস্তি দেওয়া গেলো, কিন্তু মানবজাতিকে শাস্তি দেয়া না গেলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না জিউস। ডেকে পাঠালেন দেবতা হেফুন্তুসকে। হেফুন্তুসকে বললেন, জলকাদা দিয়ে একটা মূর্তি তৈরি করে দাও।
মূর্তিটা যেন দেখতে সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মতো হয়। হেফুন্তুস আফ্রোদিতিকে দেখে বানিয়ে দিলেন জলকাদার এক মূর্তি। দেবতা জিউস তাকে জীবন দিলেন। তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম নারী। অপরূপা। সুন্দরী।
প্রত্যেক দেবতাই অবদান রাখেন প্যান্ডোরা কে গড়ে তুলতে, সবাই কিছু না কিছু উপহার দেন প্যান্ডোরাকে তৈরী করার জন্য। আফ্রোদিতি তাকে দেয় সৌন্দর্য্য-লাবণ্য-আকাঙ্ক্ষা। হার্মিস তাকে দেয় চাতুর্য ও দৃঢ়তা। এ্যাপোলো নিজে তাকে সঙ্গীত শেখান, এভাবে প্রত্যেক দেবতাই তাদের নিজেদের সেরাটা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন প্যান্ডোরাকে। সবশেষে দেবরাজ জিউসের স্ত্রী হেরা প্যান্ডোরাকে উপহার দেন হেরার অনন্য বৈশিষ্ট্য কৌতূহল।
প্যান্ডোরাকে দেবতাদের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয় এপিমেথেউসের কাছে। বলা হয় তার ভাই প্রমেথিউসের কাজের জন্য তার ওপর কোন রাগ নেই, এজন্য জিউস তার তার জন্য এই উপহার পাঠিয়েছেন। যদিও এপিমেথেউসের ভাই প্রমিথিউস তাকে নিষেধ করেছিলো দেবতাদের দেওয়া কোনও উপহার যেন তিনি গ্রহণ না করেন।
কিন্তু প্যান্ডোরাকে দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ে যান এপিমেথেউস। এপিমেথেউস-প্যান্ডোরার বিয়েতে প্যান্ডোরাকে দেবরাজ জিউস উপহার দেন এক অপূর্ব বক্স, কিন্তু তিনি তাকে এই বক্সটি খুলতে নিষেধ করে দেন।
জিউস বলেন, যতদিন এটি বন্ধ থাকবে ততদিন ই প্যানডোরা আর এপিমেথেউস সুখে-শান্তিতে সংসার করতে পারবে।
কিন্তু কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বিয়ের উপহারটি দেখতে বক্সটি খোলেন প্যান্ডোরা। খোলামাত্র বক্সবন্দী স্বর্গীয় সকল নীচতা বক্স থেকে একে একে বের হয়ে আসে। রোগ-জরা-হিংসা-দ্বেষ-লোভ-মিথ্যা ইত্যাদি সব স্বর্গীয় নীচতা ছড়িয়ে পরে মানুষের পৃথিবীতে। প্যান্ডোরা যখন বক্সটি বন্ধ করতে পারে তখন শুধু আশা রয়ে যায় সেই বক্সের মধ্যে। জিউস বক্সের ভেতর ‘আশা’ও দিয়েছিলেন । যার কারণে মানুষ শত মন্দ পরিস্থিতিতেও আশা ছাড়ে না। ঠিকই সুদিনের আশায় থাকে।
এভাবেই পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র সর্বগুণে গুণান্বিত স্বর্গীয় মানবী পৃথিবীর জন্য নিয়ে আসেন নারকীয় দুর্ভোগ।
গ্রিক পুরাণে পান্ডোরার বক্সটির কাহিনীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়, কীভাবে মানুষ মরণশীল হয়েছিল এবং কীভাবে মানুষের চরিত্রে সমস্ত মন্দ দোষগুলি অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো।
এরপর থেকেই মহৎ মানুষদের দোষ-ত্রুটি প্রকাশের ক্ষেত্রে প্যানডোরা বাক্স খোলা ব্যাপারটিকে প্রতীকী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।