বয়স কখনো স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যেমন পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের নারী জোসিলিন নিকোল জনসনের। লেখালেখির স্বপ্নটা তার আজন্ম লালিত। তারুণ্যে তারই সমবয়েসি এক লেখিকা ১৮ বছরের এস ই হিনটনের বই ‘দ্যা আউটসাইডার’ পড়ে উদ্দীপিত হয়েছিলেন নিজে বই লেখার প্রতি।
জোসিলিন নিকোল জনসন ৫০ বছর বয়েসী এক স্কুল শিক্ষিকা। সম্প্রতি ‘মাই মন্টিসেলো’ শিরোনামে পাঁচটি গল্প নিয়ে লিখেছেন একটি ছোট গল্পের বই । গত ৫ অক্টোবর বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটি নিয়ে উচ্ছ্বসি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পুলিৎজার বিজয়ী লেখক কোলসন হোয়াইট হেড। তিনি বলেন, ‘মাই মন্টিসেলো’ বইটি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলার মতো, গোছানো এবং খুবই উত্তেজনাপূর্ণ’। বইটির প্রকাশক হেনরি হল্টসহ আরো অনেক সাহিত্যবোদ্ধাই এর প্রশংসা করেছেন অকুন্ঠচিত্তে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে একে জোর আলোচনায় এনেছে অনলাইন সম্প্রচার মাধ্যম নেটফ্লিক্স। তারা ঘোষণা দিয়েছে যে, জোসিলিনের বইয়ের নামগল্প ‘মাই মন্টিসেলো’ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের থমাস জেফারসন ও স্যালি হেমিংসে সাদা আধিপত্যবাদীদের ডাকাতি থেকে বাঁচতে মন্টিসেলোতে আশ্রয় নেওয়া এক যুবতী এবং একদল কৃষ্ণাঙ্গের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে রচিত হয়েছে গল্পটি। নেটফ্লিক্স বলছে, তারা খুব শিঘ্রই সিনেমার কাজ শুরু করবে।
জোসিলিনের বইটি আরো একটি কারণে অসাধারণ। সেটি হলো লেখকের বয়স। ৫০ বছর বয়েসে বের হয়েছে এই লেখকের প্রথম বই। ৫০ বছর বয়সে প্রথম বই বের করা লেখকদের জন্য কোনভাবেই গড়পড়তা বয়স নয়। সাধারণত বই লেখার ক্ষেত্রে তরুণদের নিরুৎসাহিত করা হলেও এতো বেশি বয়সও ভালো চোখে দেখা হয়না বই প্রকাশের ক্ষেত্রে। এত বেশি বয়েসে বই প্রকাশ একটি বিরল ঘটনাই।
শার্লটভিলে বসবাসকারী এই লেখকের স্বামী একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার এবং ফটোগ্রাফার। তাদের ১৫ বছর বয়েসি এক ছেলেও আছে। তারা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন বইটি নিয়ে। বইটি নিয়ে লেখিকা বলছেন, ‘আর্টের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমাকে সেটাই বলতে পারি, যা আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলি যে, তুমি একট কিছু তৈরি করেছে কিন্তু যা তৈরি করেছে সেটা আসলে তুমি না’।
সাহিত্য পড়ার ঝোঁক ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। আর সেখান থেকেই লেখালেখির আগ্রহের বীজ রোপিত হয় তার মনে। তাই প্রকাশ না করলেও লিখেছেন নিয়মিত। তবে স্কুলে পাঠদান, পরিবার সামলানোর চাপে খুব বেশি মনোনিবেশ করতে পারেননি। তবে অল্প অল্প করে লিখেছেন নিয়মিত। তার ভাষ্যমতে তিনি ১৬ বছর বয়েসে একটি উপন্যাস লিখেও ফেলেছিলেন। যদিও সেটা বই আকারে প্রকাশ করা হয়নি। তার পাণ্ডুলিপি এখনো তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে সযত্নে রক্ষা করছেন তিনি।
সম্প্রতি ‘মাই মন্টিসেলো’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান জোসিলিন জনসন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে বইটির গল্পগুলো লিখেছিলেন। তরুণ বয়েসে সেগুলো প্রকাশ করার আগ্রহ থাকলেও আর করা হয়নি। তবে কখনো আশা ত্যাগ করেননি তিনি। সাহস করে উঠতে পারেননি। তার সেই তরুণ বয়েসে লেখা গল্পগুলো অবশেষে প্রকাশ করার সাহস পান ২০১৭ সালে এসে।
২০১৭ সালে ‘কন্ট্রোল নিগ্রো’ নামে একটি গল্পের পাণ্ডুলিপি জমা দেন একটি পত্রিকায়। প্রকাশের পর সেটি ‘বেস্ট আমেরিকান শর্ট স্টোরি’র মনোনয়নের জন্য পাঠানো পাঠানো হয়েছিল। যদিও সেটি বেস্ট আমেরিকান শর্ট স্টোরি হতে পারেনি। তবে ওটাই সূচনা। ওটা দিয়েই তার ‘মাই মন্টিসেলো’র যাত্রা শুরু। তার আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এমন না। ওই গল্প প্রকাশের পরও তিনি সাহস করে ওঠতে পারছিলেন না যে, তিনি আসলে তার লেখা বই আকারে প্রকাশ করবেন কিনা। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সাহস করতে পেরেছেন। অবশেষে ২০২১ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখে এসে তার বই প্রকাশিত হয়েছে। এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজিমাত। লেখক-বোদ্ধা মহলে প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি নজর কেড়েছে নেটফ্লিক্সেরও। আর তাতেই যেন তার দাম আরো বেড়ে গেছে।
শিক্ষকতা করেছেন ২০ বছর। স্কুলে পড়ানোর কারণে সময় বের করতে পারতেন না। তবুও অনেক কষ্ট করে বের করে নিয়েছেন সময়। স্কুল-পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি নিজের লেখালেখির জন্য সময় বের করেছেন। কোন কিছুর কাছেই নিজের স্বপ্ন বিকিয়ে দেননি।
একজন লেখক হয়ে ওঠতে তার নিজের ভেতরের শক্তি তাকে সাহায্য করেছে। স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতাও তাকে সাহায্য করেছে। তার পরিবার এবং তার স্কুলের সহকর্মীরা তার এই স্বপ্নের যাত্রায় সহায়তা দিতে কসুর করেনি। এগুলোই তাকে বই বের করার উদ্যোগ নিতে সাহস যুগিয়েছে।
বয়স ৫০, জীবনের শেষের শুরু হয়ে গিয়েছে। আরো লিখবেন কি জোসিলিন? হ্যাঁ! অবশ্যই লিখবেন। কেন লিখবেন না। যিনি শুরুই করলেন ৫০ এ, তাকে সেঞ্চুরির জন্য তো আরো বহুদূর যেতে হবে তাই না? তাই তার যাত্রা থামছে না। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বই লেখার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন একটি প্রকাশনীর সঙ্গে।
জীবন নিয়ে জোসিলিনের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সাধারণ। নিজে যেভাবে নিজের জীবন কাটিয়েছেন সেরকমই পরামর্শ সবার জন্য। ছোট কিছুর পরিকল্পনা করে ছোট কিছু দিয়ে শুরু করতে হবে। তবে শুরু করতেই হবে। থেমে থাকার কোন নিয়ম নেই জোসিলিন নিকোল জনসনের জীবনে। আর তাই তো ৫০ বছর বয়েসে এসেই নিজেকে নতুন পরিচয়ে চেনালেন তিনি। তার নতুন পরিচয় তিনি ‘মাই মন্টিসেলো’র স্রষ্টা।
জীবনের ৫০ টি বছর পেরিয়ে এসেও যিনি দুনিয়ার সামনে নিজেকে এভাবে চেনাতে পারেন তাকে সুখ, সমৃদ্ধি আর ইতিবাচকতার প্রতীক সূর্যমুখী বলাই যায়। তাই জোসিলিন নিকোল জনসনে আমাদের দেরিতে ফোটা এক সূর্যমুখী।