আইসিসি ট্রফি জয়: স্মৃতির পাতায় বাংলাদেশের সেই কীর্তি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১৪, ২০২২, ০৭:৫৬ এএম

আইসিসি ট্রফি জয়: স্মৃতির পাতায় বাংলাদেশের সেই কীর্তি

২৫ বছর আগেকার ১৩ এপ্রিলের এই দিন। তখন ঢাকা ভার্র্সিটিতে পড়ি। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকি। হল থেকে বাসে করে সেদিন জরুরি বাড়ি যাচ্ছি। তখন ক্রিকেট খেলা দেখার নতুন দর্শক আমি। ফলে ক্রিকেট খেলা দেখা একটা নেশার মতন হয়ে গেছে। আগেরদিনই বাংলাদেশ দল আইসিসি ট্রফিতে ফাইনালে গেছে, কেনিয়ার সাথে ফাইনাল খেলা। এ নিয়ে দেশজুড়ে মহা শোরগোল, উত্তেজনা চলছে। আজকের দিনেও ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদণা হয়। কিন্তু তখনকার সময়ের সেই ক্রিকেট উত্তাপ এখনকার থেকে শতগুনে বেশি ছিল। মনে আছে, বৃষ্টির কারণে  সেই খেলা গড়িয়েছিল আবার দ্বিতীয় দিনে। আগের রাতে অনেকের ঘুম হয়নি ভাল মতো। 

সেই খেলা দেখা বাদ দিয়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ। কিন্তু সেই মন খারাপ করাটা বেশিক্ষণ থাকেনি। যাত্রাপথে বাসের মধ্যেই একজনের কাছে পাওয়া গেল রেডিও। তখন মিনি সাইজের এক ধরনের পকেট রেডিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রেডিওটির কালার ছিল সিলভার। তো ওই ব্যক্তি তাঁর সেই রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য ছেড়ে দিলেন। আর যায় কোথায়! গোটা বাস ভেঙে পড়ল ওই রেডিওর ধারাভাষ্য শোনার জন্য। বাংলাদেশের পক্ষে একটা করে রান হয়, আর বিরাট উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা বাস।

আমাদের টাঙ্গাইলের বাস তখন গাজীপুর-টঙ্গী দিয়ে যাতায়াত করে। আশুলিয়ার রাস্তাটি তখনও বানানো হয়নি। তো বাস গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টাঙ্গাইলের দিকে ছুটে চলেছে। ওদিকে চলছে খেলার ধারাভাষ্য। সেই ধারাভাষ্য শুনে উৎসব মুখর এক পরিবেশ বাসজুড়ে। মনে হল গোটা বাসটির যাত্রীরা নিজ নিজ বাড়ি বা গন্তব্যে যাচ্ছে না,  পিকনিকে যাচ্ছে। পুরো বাসই এখন হয়ে গেছে পিকনিক বাস! এরইমধ্যে খেলার শেষ দিকের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে উঠল।

ধারাভাষ্যকারদের মুখে বারবার ‘কুয়ালালামপুর কিলাত কিলাব মাঠ’ শুনতে শুনতে স্টেডিয়ামটির নামও মুখস্ত হয়ে গেছে আমাদের। দরকার ১ বলে ১ রান। গরডন গ্রিনিজ, আকরাম খান, সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন অনেক আগেই, বলে চলেছেন ধারাভাষ্যকাররা।

ব্যাটিং প্রান্তে হাসিবুল হোসেন শান্ত। শুধু আমাদের বাসই নয়, পুরো বাংলাদেশের মানুষ রেডিওতে কান পেতে রয়েছে। তখন টেলিভিশন কম ছিল দেশে। তো, রেডিওতে চৌধুরী জাফরউল্লাহ শরাফাতের প্রাণবন্ত কমেন্টারিতে মনোযোগ সবার। আবেগি ধারাভাষ্যের জন্য তিনি তখন বেশ আলোচিত। তিনি বলে চলেছেন:

কেনিয়ার মারটিন সুজির লেগ সাইডের বল পায়ে লেগে লেগ বাই, শান্তকে শান্ত রাখা গেল না। রান নিয়ে ছুটলেন। আরেক নায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটও ছুটলেন। রচনা হল ইতিহাসের। বাংলাদেশ অ-প-রা-জি-ত চ্যা-ম্পি-য়-ন। ক্রিকেট বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াল আরও একটি দেশ।

এদিকে বাইরে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল শুরু হয়ে গেছে, বাসে কেউ কেউ বলতে লাগল মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পরও এভাবে বিজয় মিছিল হয়েছিল একাত্তরে। বাসের জানালায় চোখ রাখলাম। এরইমধ্যে এক শ্রেণির তরুন রঙ-পিচকারি নিয়ে বের হয়েছে পথে। সবাইকে তারা পিচকারি মেরে মেরে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আমার পাশের সিটে ছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পরা এক প্রবীণ রাশভারী ভদ্রলোক। চুপচাপ বসেছিলেন। এক পর্যায়ে পিচকারি থেকে ছুড়ে দেওয়া একদলা লাল-সবুজ-নীলের রঙমিশ্রণ এসে পড়ল তাঁর পাঞ্জাবিতে। বাসের সবাই ভড়কে গেলাম এই ভেবে যে, এই ভদ্রলোক এবার ক্ষেপে যাবেন নিশ্চিত!

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি এবার মৃদু হেসে উঠলেন আর জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে তরুনদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বললেন, বাবারা! রঙ ছিটাও। আরও বেশি করে ছিটাও। জিতছি আমরা! আমাদের ছেলেরা জিতছে। সাবাস!

চাচার ওই কীর্তিতে আমরা কয়েক মূহুর্ত থ হয়ে গেলাম এবং পরে সবাই আবার উচ্ছ্বাসে যোগ দিলাম। বাস টাঙ্গাইলের পথে তখন আরও জোরসে চলছে।

নবীন বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিলের এই দিনটিতে এভাবেই আইসিসি ট্রফি জয় করে ইতিহাস রচনা করেছিল। আমার জীবনে চির স্মরণীয় দিনগুলোর একটি এ দিনটি। আগের দিন ১২ এপ্রিল নির্ধারিত ছিল ফাইনালের দিন। ওইদিন প্রথমে ব্যাট করা কেনিয়া স্টিভ টিকোলোর অনবদ্য সেঞ্চুরিতে (১৫২ বলে ১৪৭ রান) তুলে ৭ উইকেটে করে ২৪১ রান। কেনিয়ার ইনিংস ভালোভাবে শেষ হলেও বাংলাদেশের ইনিংস শুরুর আগেই নেমেছিল তুমুল বৃষ্টি। তারপর হেলিকপ্টার দিয়ে মাঠ শুকানো হলেও ওইদিন আর খেলা সম্ভব হয়নি। ফাইনাল গড়ায় পরদিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল। ডিএল মেথডে আকরাম বাহিনীর সামনে আইসিসি ট্রফি জিততে নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয় ২৫ ওভারে ১৬৬ রানের। শেষ ওভারে ১১ রান দরকার থাকা অবস্থায় খালেদ মাসুদ পাইলটের ঐতিহাসিক ছক্কা। আর শেষ বলে ১ রান দরকার থাকা অবস্থায় লেগ বাই থেকে জয়সূচক রান পাওয়া। শর্ট ফাইন লেগে বল যেতেই হাসিবুল হোসেন শান্ত আর খালেদ মাসুদ পাইলটের জয়সূচক রান নিয়ে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফেরা। বিজয়ের সব দৃশ্যই ধারাভাষ্যকাররা সেদিন আমাদের রেডিও শ্রোতাদের মনের মধ্যে এঁকে দিয়েছিলেন।

এই জয়ের কল্পদৃশ্য কখনো ভোলার নয়। 

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

 

Link copied!