ভারতের উত্তরপ্রদেশ অযোধ্যায় ষোল শতকের বাবরি মসজিদ নিয়ের কয়েক দশক ধরে তিক্ত বিরোধ ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। মসজিদ নির্মাণ নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের দাবি ও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ইতিহাস বর্ণনাতেও আছে বহু অমিল। নানা বিতর্ক উপেক্ষা করে অযোধ্যা শহরে ৩২ বছর আগে হিন্দু জনতাদের ধ্বংস করে দেওয়া বাবরি মসজিদের জায়গায় হিন্দু দেবতা রামের নামে নির্মাণ করা হয়েছে রাম মন্দির।
হিন্দু সম্প্রদায়ের রাম মন্দির ও মুসলমানদের বাবরি মসজিদের রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। তারিখটা ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল। জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের কাছে পরাজিত হলেন দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদি। শুরু হলো ভারতে মুঘলদের রাজত্ব। এর ঠিক বছর দুয়েক পরে অযোধ্যায় নির্মিত হলো একটি মসজিদ। তৈরি করলেন বাবরের সেনাপতি মীর বাঁকি। আর এই সেই অযোধ্যা, যা রামায়ণে ভগবান রামচন্দ্রের জন্মভূমি বলে পরিচিত।
প্রায় চার শ বছর এভাবেই চলল। মসজিদে নামাজের পাশাপাশি পাশের চবুতরায় চলতো পূজাপাঠ, কীর্তন সবই। কোনো অসুবিধাই হয়নি। অযোধ্যায় মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ তৈরি করেনি এ ঘটনা। তবে কবে যে এই মসজিদের নাম বাবরি মসজিদ হলো তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো, প্রতিষ্ঠাতা মীর বাঁকি তাঁর সম্রাটের নামেই এই মসজিদের নামকরণ করেছিলেন।
গোলমালের সূত্রপাত ১৮৫৩ সালে। তখন দিল্লিতে মুঘল শাসন টিমটিম করে জ্বলছে অনেকটা ব্রিটিশদের দয়ায়। নিজের মতো করে এলাকার ইতিহাস রচনায় ততদিনে দক্ষ হয়ে উঠেছে ইংরেজ। এই সময় প্রথম স্থানীয় হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে দাবি করা হলো, বাবরের আমলে মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় মসজিদ তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে শুরু হলো সিপাহী বিদ্রোহ, যা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে পরিচিত। এই বিদ্রোহ বা সংগ্রাম দমন করার পরে ১৮৫৯ সালে বাবরি মসজিদের চারপাশে বেড়া দিয়ে দিল ব্রিটিশরা। নিয়ম করল, মুসলমানরা মসজিদে নামাজ পড়বে। আর হিন্দুরা বেড়ার বাইরে থেকে পূজা করতে পারবে।
এভাবেই চলল ৯০ বছর। ততদিনে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের গায়ে বিতর্কের লেবেল লেগে গেছে। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারত স্বাধীন হওয়ার দুইবছর পর ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর গভীর রাতে মসজিদের ভেতরে রাম ও সীতার পুতুল সদৃশ মূর্তি রেখে এলেন জনৈক হিন্দু পুরোহিত। এই ঘটনায় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও উপ প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। নির্দেশ দিলেন মূর্তি সরানোর। কিন্তু স্থানীয় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের একক সিদ্ধান্তে মানা হলো না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।
শেষমেষ বিতর্ক এড়াতে মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দিল সরকার। বন্ধ হয়ে গেল নামাজ। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় এই নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিতর্ক চলার পর ১৯৯২ সালে বিজেপির অভিভাবক সংস্থা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতৃত্বে একদল উগ্র করসেবক (আরএসএসের কর্মীবাহিনী) বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে। এ ঘটনার জেরে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় ভারতে এবং সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত ২ হাজার মানুষ। এই নিহতদের মধ্যে ছিলেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ।
২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যদিও মন্দিরের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আরও এক বছরের বেশি সময় লাগবে। তবে এর সাথে স্বাধীন ভারতের ইতিহাস নতুন বাঁক নিলো। এখন সেই পথ কোথায় যায়, সেটাই দেখার বিষয়।