যে কারণে জাতীয় পার্টির ছয়শোরও বেশি নেতাকর্মীর পদত্যাগ

বিবিসি

জানুয়ারি ২৬, ২০২৪, ০২:০৮ এএম

যে কারণে জাতীয় পার্টির ছয়শোরও বেশি নেতাকর্মীর পদত্যাগ

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে অনাস্থা জানিয়ে ও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দলটির ঢাকা মহানগর উত্তরের আটটি থানার ৬৬৮জন নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেছেন।

বিকেলে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই পদত্যাগের কথা জানান দলটির ওই নেতা-কর্মীরা।

নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলীয় নেতৃত্বের অসহযোগিতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা-সহ নানা অভিযোগে নির্বাচনের পর থেকেই নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ, চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেওয়া ও কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পর এই ঘটনা ঘটলো।

যা বলছেন পদত্যাগ করা নেতারা

কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করা মো. জাহাঙ্গীর আলম পাঠান এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, “মহানগর উত্তরের ২৫টি থানার মধ্যে আটটি থানার সাড়ে ছয়শোর বেশি নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেছে। তারা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছে।”

এর আগে দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে বিক্ষোভ করে নেতা-কর্মীরা।

বিক্ষোভের ঘটনার পর দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়-সহ বেশ কয়েকজনকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়া ঢাকা মহানগরের উত্তরের কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়।

মি. পাঠান জানান, “এটার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন তারা। এর পরে সারা দেশের বিভিন্ন কমিটি থেকেও পদত্যাগ করার কথা রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পার্টি থেকে পদত্যাগ নয়, বরং জিএম কাদেরের কমিটি থেকে গণ পদত্যাগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।”

মি. পাঠান কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। তা ছাড়া বিলুপ্ত ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সদস্য সচিবও ছিলেন। টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদে দলটির নেতাকর্মীদের পদত্যাগের পক্ষে গণস্বাক্ষর করতে দেখা যায়।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যা বলছে

দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের দলের নেতা-কর্মী বেশি, তাদের স্বাধীনতা আছে। তারা পদত্যাগ করছে এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য নাই, কোনও পদক্ষেপ নাই।”

“আমরা যাদেরকে অব্যাহতি দিছি, তারা পদত্যাগ করতেছে। এটা আমাদের কাছে ম্যাটার করে না, আমাদের সাথে কথা বলার আর কোনও সুযোগ নাই”, বলেন মি. হক।

পদত্যাগ করা নেতাকর্মীরা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নতুন করে দল গোছানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এ বিষয়টি উল্লেখ করলে মি. হক বলেন,“যার খুশি যে পার্টি করতে পারে। একটা কেন ৪০টা করতে পারে এটা তাদের স্বাধীনতা আছে। এটা আমাদের কোন বিষয় না!”

যা রয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে

সংবাদ সম্মেলনে নেতারা জানান, বর্তমান নেতৃত্ব জাতীয় পার্টিকে ভুল পথে পরিচালিত করছে, তারা দলটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে।

দলে সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে কাউন্সিলের প্রস্তুতিও চলছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

মো. জাহাঙ্গীর আলম পাঠান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে বুঝতে পারলাম চেয়ারম্যান জি এম কাদের গোপনে সরকারের সাথে আঁতাত করে নিজের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।"

এতে বলা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব ৩০০ আসনে প্রার্থী মনোনীত করার পর মাত্র ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাবার বিনিময়ে গোটা পার্টিকেই বিক্রি করে দিয়েছে।

“দলকে ধ্বংসের প্রান্তে নেয়ার পর চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এই দুরবস্থার মধ্যেও চেয়ারম্যান নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করে পার্টির নিবেদিতপ্রাণ নেতৃবৃন্দকে একের পর এক অব্যাহতি দিয়ে চলেছেন। পল্লী-বন্ধু এরশাদের নাম নিশানা মুছে দেয়ার হীন চক্রান্ত করে যাচ্ছেন।”

এই বিজ্ঞপ্তিতে আরো যোগ করা হয়েছে, “পল্লী-বন্ধু এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির ধ্বংস দেখতে চাই না। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা এরশাদের চেতনা, প্রেরণা ও নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকব।”

তবে, গণ-পদত্যাগের কোনও চিঠি দলীয় কার্যালয় বা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এখনও পাঠানো হয়নি।

গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে জাতীয় পার্টিতে নানা ধরনের অস্থিরতা চলছে।

নির্বাচনে ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দেয় দলটি। পরে ২২৫টি আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

২৬টি আসনে সমঝোতার পর মাত্র ১১টি আসনে জিততে পেরেছে দলটি। প্রার্থীদের ৯০ শতাংশরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

এখনও পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যা ইঙ্গিত দিয়েছে তাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিই স্বীকৃতি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এর আগে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “আমরা বিরোধী দল হওয়ার জন্য দলের সিদ্ধান্ত স্পিকারকে জানিয়েছি। এখন তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।”

“গত টার্মেও আমরা বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের দু-একজন সদস্যের কথাবার্তায় দলের মধ্যেও আপত্তি ছিলো। আমরা অতীতে যেভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছি, ভবিষ্যতেও সেভাবে পালন করবো”, বলেন মি. হক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, ‍‍`‍‍`সরকারের নিজেদের জন্য জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধী দল প্রয়োজন। সুতরাং, আসন যাই হোক, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে ছাড়বে না সরকার।"

আগামী ৩০শে জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে এবারই প্রথম দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি।

এর আগে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২৭টি আসনে জয় পেয়েছিল জাতীয় পার্টি।

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জেনারেল এরশাদ প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে হয়েছিল।

এরপর সমঝোতার মাধ্যমে ২০১৪ সালে ২৯টি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে দলটি।

সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই সমঝোতা নিয়ে অস্বস্তি চাপা থাকেনি। তখন দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতাও দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে।

Link copied!