শোকজ দিয়েও থামানো যাচ্ছে না সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনি প্রচারণা

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী

ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩, ০৯:১৯ পিএম

শোকজ দিয়েও থামানো যাচ্ছে না সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনি প্রচারণা

শোকজের তালিকায় শিক্ষকদের সংখ্যা বেশি।

নির্বাচনে শোকজ নোটিশ শুধু মাত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রেই নয় এবার তা গড়াচ্ছে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের ঘাড়েও। গত ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কিছু কর্মকর্তাকে শোকজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নৌকার প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় ৮ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে। তবে শোকজ দিলেও কোনো শাস্তি না দেয়ার ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেয়ার প্রবণতা কমছে না বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

শোকজের তালিকায় শিক্ষকদের সংখ্যা বেশি

নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রচারণায় অংশগ্রহণ করার প্রবণতা শিক্ষকদের মধ্যে বেশি দেখা গিয়েছে। মাদারীপুর-৩ আসনে নির্বাচনে ভোট গ্রহণে দায়িত্ব পাওয়া শিক্ষকদের নিয়ে নৌকার পক্ষে বৈঠক করায় ৩৭ জন শিক্ষককে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বৈঠকের ৩ মিনিট ৩ সেকেন্ডের এরকম একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার সকাল ৯টার দিকে মাদারীপুর-২ আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সংসদ সদস্য শাজাহান খানের বাসভবনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সদর উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নৌকার প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় ৮ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ ১২ জনকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) ১২ জনকে চিঠি দিয়ে ২৭ ডিসেম্বর কারণ দর্শাতে নির্দেশ দিয়েছেন নির্বাচনি এলাকা ২০৫ (আড়াইহাজার) এর নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি ও সিনিয়র সহকারী জজ ধীমান চন্দ্র মন্ডল।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। তাই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি তাদের নোটিশ দিয়েছে। 

পাবনা-৩ আসনে (চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর) নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় নয় শিক্ষককে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। তাদের অনেকেই নির্বাচনি দায়িত্বে থাকবেন। সেই সাথে নারায়ণগঞ্জ- ১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রচারণা করতে। 

এদিকে শোকজ পাওয়ার পরও আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়মা আফরোজ ইভা নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে নির্বাচনি সভায় অংশ নিয়ে তার স্বামী নৌকার প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুর পক্ষে ভোট চেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে চট্টগ্রাম-১২, (পটিয়া) আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী সাবেক সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর পক্ষে পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এসআই ও এএসআইর প্রচারণার অভিযোগ তুলেন।

এছাড়া সংসদের যুগ্ম সচিব কিবরিয়া মজুমদারকে শোকজ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব একেএমজি কিবরিয়া মজুমদারকে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে শোকজ করেছে নির্বাচনি তদন্ত কমিটি। বুধবার সরকারের এ কর্মকর্তাকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালানোয় শোকজ করা হয়।

নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাই চূড়ান্ত

নির্বাচনি কর্মকর্তাগণ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ১৪(২) এর লঙ্ঘন করায় শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছিল অধিকাংশ কর্মকর্তাকে। নির্বাচনি কর্মকর্তাদের বিধি অনুযায়ী ১৩ নং আইনের ৫( ১,২) ধারায় তাদেরকে নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে অব্যাহত রাখা হচ্ছে। 

আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শোকজ অনেকটা আদালতের মতোই কাজ করছে। নির্বাচনের স্বার্থে যেকোনো ধারায় শাস্তি হতে পারে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে অনেক কর্মকর্তাকেই নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) কেন্দ্রীয় সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, নির্বাচনি প্রচারণায় শিক্ষকদের থাকার সুযোগ নেই। তবে অনেক সময় বিভ্রান্তির কারণে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তবে ইসি তদন্ত সাপেক্ষে দোষী কারও বিরুদ্ধে নির্দেশনা দিয়ে আসছে।

এদিকে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুসারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেগুলোর বিরুদ্ধেও নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাই তাদের সহায়তা করাই আমাদের কাজ।

যা আছে নির্বাচনি বিধিমালায়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে নির্বাচনি বিধিমালা ২০০৮ এর নির্বাচনি কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের বেশকিছু বিধিমালা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনি কর্মকর্তা ওই এলাকার যে কেউ হতে পারেন। নির্বাচনী বিধিমালা সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ১৪ অনুসারে ১১৪ অনুচ্ছেদে সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনি প্রচারণা নিয়ে বিস্তারিত রয়েছে। 

সেখানে (১) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি বা কর্মকান্ড যোগ করতে পারবেন না।

(২) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধাভোগ করতে পারবেন না এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যবহার করিতে পারবেন না। 

৩) কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার নির্বাচনি এলাকায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্তৃত্ব করতে পারবেন না কিংবা এতদসংক্রান্ত সভায় যোগদান করিতে পারবেন না।

এমনকি নির্বাচনি এজেন্ট না হলে সরকারি কর্মকর্তারা ভোট গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেনা। কিংবা নির্বাচনি সফরেও যেতে পারবে না। 

প্রচারণায় অংশ নিলে যে শাস্তির বিধান

তবে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের বিধানকল্পে প্রণীত আইন অনুযায়ী আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের বিশেষ বিধান আইন,১৯৯১ সনের ১৩ নং আইনের ৫ এবং ৬ ধারায় শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। 

ধারা ৫ এবং ধারা ৬ অনুযায়ী শাস্তিগুলো হচ্ছে:

৫। (১) কোন নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে প্রদত্ত কমিশন বা ক্ষেত্রমত রিটার্নিং অফিসারের কোন আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বা নির্বাচন সংক্রান্ত কোন আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা তার অধীন কোন অপরাধ করলে তিনি অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উত্তরূপ অসদাচরণ তার চাকুরী বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

(২) কোন নির্বাচন-কর্মকর্তা উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অসদাচরণ করলে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ

তাহাকে চাকুরী হতে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারিবে বা তাহার পদাবনতি করতে পারবে বা তার পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি অনধিক দুই বৎসরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবেঃ

তবে শর্ত থাকে যে, উক্তরূপ কোন শান্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি, লংঘণ বা অপরাধের জন্য অন্য কোন আইনে নির্ধারিত কোন দণ্ড প্রদান বা উহার জন্য কোন আইনগত কার্যধারা গ্রহণ ব্যাহত করবে না।

(৩) কোন নির্বাচন-কর্মকর্তা উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অসদাচরণ করলে কমিশন বা ক্ষেত্রমত কমিশনের সম্মতিক্রমে রিটার্নিং অফিসার তার বিরুদ্ধে তজ্জন্য তাহার চাকুরীবিধি অনুযায়ী শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা গ্রহণ সাপেক্ষে, অনধিক দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে চাকুরী হতে বরখাস্তের আদেশ দিতে পারবেন এবং উক্তরূপ বরখাস্তের আদেশ তাহার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাহার চাকুরী বিধি অনুযায়ী প্রদত্ত হইয়াছে বলে গণ্য হবে এবং তদনুযায়ী কার্যকর হবে।

(৪) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অসদাচরণের জন্য কোন নির্বাচন-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা গ্রহণের জন্য কোন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে কমিশন বা ক্ষেত্রমত রিটার্নিং অফিসার অনুরোধ করলে উক্ত কর্তৃপক্ষ উক্তরূপ অনুরোধ প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যে উক্তরূপ কার্যধারা গ্রহণ করবে এবং তৎসম্পর্কে কমিশনকে অবহিত করবে।

৬। (১) কোন ব্যক্তি ধারা ৪(১) বা ৪(২) এর বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক এক বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

(২) কোন ব্যক্তি ধারা ৫(৩) এর অধীন প্রদত্ত কোন আদেশ পালন বা কার্যকর না করলে বা ধারা ৫(৪) এর বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ডে, বা অনধিক দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

Link copied!