জীবনানন্দ দাশ: এক মরণোন্মুখ জীবন

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২২, ২০২১, ০৬:৩৯ পিএম

জীবনানন্দ দাশ: এক মরণোন্মুখ জীবন

‘একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব

আবার কি ফিরে আসব না পৃথিবীতে?

আবার যেন ফিরে আসি

কোন এক শীতের রাতে

একটা হিম কমলালেবুর মাংস নিয়ে

কোন এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানায়।’_কমলালেবু, জীবনানন্দ দাশ

মৃত্যুশয্যায় কমলালেবুই খেতে  চেয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। চাকরি হারানোর পর জীবন যখন নিতান্ত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, এমনই কোনও এক বিকালে প্রথম ও শেষ ব্যক্তি হিসাবে কলকাতায় ট্রাম দূর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তার মৃত্যুকে অনেকেই আত্মহত্যা বলেই ধারণা করেন।

তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারনা করার যথেষ্ট কারনও আছে। তার লেখায় অনেকবার আত্মহত্যার কথা তুলে ধরেছেন। ‘আট বছর একদিন’কবিতার মূল বিষয়ই আত্মহত্যা। তার ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে সরাসরি আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা আছে। দূর্ঘটনার কয়েকদিন আগেও কেউ ট্রাম দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন তিনি।

১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রয়ারি বরিশালের সত্যানন্দ দাশগুপ্তের ঘরে জীবনানন্দ জন্মেছিলেন। বাবা ছিলেন বরিশাল ব্রাক্ষ্ম সমাজের একজন কর্ণধার আর মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন স্বভাব কবি। তার ডাক নাম ছিলো মিলু।

কুসুমকুমারীও চেয়েছিল তার ছেলে কবি হোক। মায়ের নির্দেশেই জীবনানন্দ তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষাআবহন’ লেখেন। ১৯১৯ সালে ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় ছাপা হয় তার কবিতা।

দেশভাগের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারনে জীবনানন্দ কলকাতা চলে যান। দেশভাগের পরে বরিশাল পাকিস্তানে আর  কলকাতা ভারতে পড়ে যাওয়ায় জন্মস্থান বরিশালে আর ফিরতে পারেননি। যদিও ধানসিঁড়ি নদীর পাড়ে ফিরে আসার আকুলতা কবির আজীবন ছিলো।

কবির ৫৬ বসন্তের ছোট্ট এক টুকরো জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পেশা মূলত শিক্ষকতা হলেও কর্মজীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কোথাও থিতু হতে পারেননি। তিনি অধ্যাপনা করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জীবিকার প্রয়োজনে কবিকে জীবনভর যুঝতে হয়েছে।

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝড়া পালক’ উৎসর্গ ছিল রহস্যময়। উৎসর্গপত্র পৃষ্ঠায় শুধু লিখেছিলেন ‘কল্যাণীয়াসুকে’। তার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি থেকে জানা যায় কল্যাণীয়াসু হল তার কাকাতো বোন শোভনা দাশ ওরফে বেবী। তার বইয়ের একটি কপি পাঠিয়েছিলেন শোভনা দাশকেও।

এই শোভনা দাশের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়েছিলেন জীবনানন্দ। ধর্মীয় শাস্ত্রমতে তাদের বিয়ে অসম্ভব ছিল।আর শোভনা ছিল বিত্তবান,কনভেন্টে পড়া চৌকস মেয়ে। তাই শোভনাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ঐ সময়কার তার লেখা কবিতাগুলো মূলত শোভনাকে নিয়েই লেখা।

দিল্লির রামযশ কলেজে চাকরির সময় বিয়ে করেন ইডেন কলেজে পড়ুয়া লাবন্যকে। বিয়ের পরপরই চাকরি চলে যাওয়ায় জীবনানন্দের জীবনে নেমে আসে দুর্বিসহ দুঃখ। চাকরির জন্য বরিশাল ত্যাগ করে কলকাতা গিয়ে মেসে উঠেন, একটা টিউশনি জোগাড় করে নিজের খরচ চালাতে লাগলেন। এরমধ্যে জন্ম নেয় তার কন্যা মঞ্জুশ্রী।

দাম্পত্য জীবনে অসুখী ছিলেন জীবনানন্দ। লাবণ্য চেয়েছিল স্বচ্ছল পরিবারের স্ত্রী হতে কিন্তু জীবনানন্দের জীবনে আর্থিক টানাপোড়ন লেগেই ছিল আর জীবনানন্দ সংসারমুখীও ছিলেন না। তার উপন্যাসগুলো বরাবরই তার জীবনের কাহিনীর প্রতিকী ছিলো।

‘জীবন প্রনালী’ উপন্যাসে অঞ্জলি তার স্বামীকে বলছে ‘বয়স তিরিস পেরিয়ে গেছে, এমএ পাশ করেছো এক যুগ আগে,তবু একটা পয়সা সম্বল নেই তোমার-মেয়েমানুষকে জীবনে আকাঙ্ক্ষা করতে গিয়েছিলে কেন?’

‘বাসর রাত’ গল্পে প্রেমনীহারের স্ত্রী মনিকা তার স্বামীকে বলছে, ‘নিজেরা কায়ক্লেশে যে সংসার চালাতে পারে না সেখানে একজন পরের মেয়েকে এনে যারা কষ্ট দেয়- তারা কি সৎ?’

বিয়ের পরই তাদের সম্পর্কে একধরনের ফাটল দেখা দেয়, দূরত্ব তৈরি হয়। যে দূরত্ব মৃত্যু পর্যন্ত ঘোচে নি।

১৯২৭ সালে নিজ খরচে প্রথম কবিতার বই ‘ঝরা পালক’ প্রকাশ করেন। বইটা জীবনানন্দ ডাকে পাঠিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ এর কাছে, সবিনয়ে অনুরোধ জানান মন্তব্যর। রবীন্দ্রনাথ থেকে পজিটিভ জবাব পাবেন বলে প্রত্যাশা ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একপ্রকার সমালোচনা করেন প্রতিউত্তরে।

জীবনানন্দ তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘ধূসর পান্ডুলিপিও’ রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠান মন্তব্য জানানোর জন্য।

এবারও জীবনানন্দকে হতাশ করলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনানন্দ প্রত্যাশা করেছিল বিষদভাবে কিছু লিখবেন। কিন্তু উত্তর দেখে মনে হল তেমন গুরুত্বের সাথে নেননি।

তখন হয়ত রবীন্দ্রনাথও তার কাব্যপ্রতিভা ধরতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথও আচঁ করতে পারেননি ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ এর মাধ্যমে ঘটে যাবে বাংলা কবিতার পালাবদল।

১৯৪৪ সালে তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশিত হয়। আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হলেও প্রথমবারের মতো তিনি তার কবিতার বইয়ের জন্য প্রকাশক পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রকাশিত এ কবিতগুলোতে যুদ্ধের প্রভাব দেখা যায়।

জীবনানন্দ ২১ টি উপন্যাস,১২৬ টি ছোট গল্প লিখলেও তিনি কোথাও প্রকাশ করেননি। তার মৃত্যুর পর তার ট্রাংক থেকে তার অপ্রকাশিত লেখাগুলো উদ্ধার করা হয়।

তারিখটা ছিল ১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল। সেদিন কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবি জীবনানন্দ আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে শরীর দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল কণ্ঠ, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়।

শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। যমে-মানুষে আট দিনের টানাটানির পর ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর রাতে হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়।

গত ১০০ বছরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। আর সেই দুর্ঘটনার শিকার, কবি জীবনানন্দ দাশ।

তথ্যসূত্র:একজন কমলালেবু-শাহাদুজ্জামান, উইকিপিডিয়া।

Link copied!