অভিনয় মঞ্চও কাপিঁয়েছেন তারাশঙ্কর

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১, ০৬:১৪ এএম

অভিনয় মঞ্চও কাপিঁয়েছেন তারাশঙ্কর

বাংলা কথাসাহিত্যের চিরস্মরণীয় লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্র প্রতিভার আলোকস্পর্শ যখন ক্রমশ বিলীয়মান, যখন শরৎচন্দ্রের দিনও প্রায় শেষ পর্যায়ে এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে তারাশঙ্করের আবির্ভাব ঘটে বাংলা সাহিত্যে। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাসাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের মৃত্যুদিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত তিন বন্দিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের যথাযথ  এই উত্তরসূরি ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের আগে সহোদরের মৃত্যু হয়। এ কারণে পুত্র সন্তানের আশায় তারা মায়ের পূজা শুরু করেন মা প্রভাবতী দেবী। পূজা শুরুর ঠিক দশ মাস পরে তারাশঙ্করের জন্ম। তারা মায়ের দয়ায় জন্মগ্রহণ করেছে-এই বিশ্বাসে বাবা-মা তার নাম রাখেন তারাশঙ্কর।

১৯১৬ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করার পর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ফলাফল  এক বছরের কারাদণ্ড ও  শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি । পরে তিনি পুরোপুরি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১৯৩০ সালে  তিনি আবারও এক বছর জেল খাটেন। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে সপরিবারে কলকাতায় স্থায়ী হন এবং সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত করেন।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে উঠেছে সাবলীলভাবে। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তার একাধিক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়বস্তু। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তারাশঙ্করের লেখনীর স্পর্শে বাংলা কথাসাহিত্য আবার নতুনভাবে আলোকিত হয়। তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোলে প্রকাশিত হয়।

দুই বাংলার পাঠক সমাজ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঔপন্যাসিক বলেই জানেন। ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’-র মতো কয়েকটি গান লিখলেও মুলত কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন।

অভিনয়ে মঞ্চও কাপিঁয়েছেন তারাশঙ্কর। এর প্রমাণ আমরা পাই তার এক প্রবন্ধে। ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘...অভিনয় ভালো লাগে, নাটক রচনা করি। সে রচনা অবশ্য তখন সলিটারি প্রাইডের সামিল আমার কাছে। মধ্যে মধ্যে জমজমাট নাট্যমঞ্চে অভিনয় করি। দেশপ্রেম, নাট্য রচনা ও অভিনয়-স্পৃহা এই তিনের সম্মিলিত ফল এক সময় দাঁড়াল একখানি পঞ্চাঙ্ক নাটক। নাম মারাঠা তর্পণ।

তারাশঙ্কর ছোটগল্প, উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করেন। ক্রমশ সাহিত্যজগতে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি দুই-ই বাড়তে থাকে। তারাশঙ্করের রাইকমল উপন্যাসটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশির ভাদুড়িকে এই উপন্যাস থেকে নাটক করার সুপারিশ করেন। ১৯৪১ সালের ১২ জুলাই নাট্যনিকেতন মঞ্চস্থ করল তারাশঙ্করের কালিন্দী নাটক। গীত রচনা ও সুর সৃষ্টি করলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজি নজরুল ইসলাম।

১৯৫৫ সালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে চীন ভ্রমণ করেন। ১৯৫৭ সালে তাসখন্দে এশীয় লেখক প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় তিনি সফর করেন মস্কোও। অর্থের প্রয়োজনে শেষদিকে কিছুদিন দৈনিক সংবাদপত্রে কলাম লিখতেন।

তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। জলসাঘর ও অভিযান (১৯৬২), অগ্রদানী, আগুন, আরোগ্য নিকেতন, উত্তরায়ণ, কবি, কান্না, কালিন্দী, গণদেবতা, চাঁপাডাঙার বউ, জয়া, ডাকহরকরা, দুই পুরুষ, ধাত্রীদেবতা, ফরিয়াদ, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, বিচারকসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র তারাশঙ্করের নাটক ও উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে।

৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পের বই, ১২টি নাটক, চারটি প্রবন্ধের বই, চারটি আত্মজীবনী এবং দুটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কর্তৃক ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন।

Link copied!