প্রচ্ছদ ও মঞ্চসজ্জায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন খালেদ চৌধুরী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২০, ২০২২, ০৫:০৮ পিএম

প্রচ্ছদ ও মঞ্চসজ্জায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন খালেদ চৌধুরী

ভারতের প্রখ্যাত মঞ্চনির্দেশক, শিল্পী ও গায়ক খালেদ চৌধুরি বাংলা ও হিন্দি থিয়েটারে মঞ্চ নির্দেশনার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন।

খালেদা চৌধুরীর জন্ম ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর আসামের করিমগঞ্জে। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবার ‘অত্যাচারে অতিষ্ঠ’ হয়ে তিনি সিলেট শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

দাদু গুরুসদয় দত্ত নাম রেখেছিলেন চিরকুমার। তারপর বহু অভিজ্ঞতা পেরিয়ে নিজেই নিজের নাম রাখলেন খালেদ চৌধুরী। ‘খালেদ’ মানে, চিরস্থায়ী।

সিলেটে থাকার সময় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সংস্পর্শে আসেন খালেদ চৌধুরি। এ সময় তিনি শুধু পোস্টার বা হোর্ডিং আঁকাই নয়, মঞ্চে উঠে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরিদের পাশাপাশি গানও গাইতেন। তাঁদেরই চেষ্টায় শিল্প শিক্ষার জন্য ১৯৪৫ সালে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। ভর্তি হয়েছিলেন আর্ট স্কুলে। প্রখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদিনের কাছে তিনি শিল্প শিক্ষায় তালিম নেওয়া শুরু করলেও ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর জয়নুল ঢাকায় চলে যাওয়ায় সেই সুযোগ আর তাঁর ঘটেনি। তবে গণনাট্য সংঘে যুক্ত হয়ে শিল্পের নানা শাখায় তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর শম্ভু মিত্র বহুরূপী প্রতিষ্ঠা করলে তিনি মঞ্চ নির্দেশনার কাজে যুক্ত হন। তার পর থেকে তিনি বহুরূপীর সব নাটকেরই মঞ্চ নির্দেশনার কাজ করেছেন।

বিস্তীর্ণ বাংলায় ঘোরাঘুরিতে দেখেছেন, এঁকেছেন তাঁর চরিত্রদের। রেখাঙ্কনে তাঁর সিদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা অবশ্য শুরু আগেই। ১৯৪৬ থেকে পরবর্তী ষাট বছরে প্রায় চার হাজার প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন। এগুলো যদিও তিনি জীবনধারণের কাজ বলে মনে করতেন। ১৯৬৫ থেকে ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ গঠন করলেন, আরও সংগঠিত ভাবে লোকায়ত জীবনের সুর অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কথা, সুর-তালের গভীর অনুসন্ধানে তিনি তখন ব্যস্ত। তীজন বাইয়ের গান রেকর্ড করতে ভিলাইতে যাচ্ছেন আবার খুঁজে খুঁজে রেকর্ড করছেন অনন্তবালা বৈষ্ণবীর গান। বলতেন, তাঁদের আগ্রহের কাজ তো সম্ভাব্য আদি রূপকে নথিবদ্ধ করা। খালেদ চৌধুরীর আগ্রহের ধরনই ছিল সংরক্ষণের কাজে, প্রসারের কাজে নয়। এ সব বোঝাতে কখনও সিলেটের শেখ ভানুর উনিশ শতকীয় দেহতত্ত্বের গানের কথা ও সুরের উপমা তুলে ধরতেন: ‘নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে রে ভ্রমরা/ নয় দরজা করি বন্ধ লইয়ো ফুলের গন্ধ হে।’

তাঁর এই বহুবিচিত্র আগ্রহের জগৎ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে বলতেন, ‘‘আমার একটা শরীরের মধ্যে গোটা চারেক পকেট আছে— একটা ফোক পকেট, একটা প্রচ্ছদ পকেট, একটা নাটক পকেট, একটা হচ্ছে বিবিধ। পাবলিশারের লোক জানতই না আমি নাটকের কাজ করি, আবার নাটকের লোক জানতই না যে আমি অন্য কাজ করি। তখন ওই পকেটগুলো বন্ধ করে দিতাম। কোনও অসুবিধা হয় না।’’ নিজের মতো করে সরল যাপনের মধ্যে তাঁর অর্জন তাঁকে দৃঢ়চেতা করেছে। রসিকতা করে যদিও বলতেন, ‘‘আমি তো জোগাড়ে!’’ এই নির্মোহ দৃষ্টিতেই বর্তমানের প্রকট আত্মপ্রচার তাঁর চোখে বেশি করে ধরা পড়ত। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে সিনেমার শিল্পী ও পরিচালকের আলোচনা শুনে তাঁর বিস্ময় উক্তি ছিল, ‘‘ওঁরা তো নিজেরাই মুগ্ধ— যাঁরা তৈরি করেছেন!’’ চটজলদি, সহজলভ্য বা রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাবাদী আশ্রয়ে আলোকিত হওয়ার বাসনা কোনও দিন তাঁর ভাবনায় আসেনি। সৃষ্টিশীল ভাবনাই জুড়ে ছিল জীবন।

সারা জীবনে বাংলা ও হিন্দি অসংখ্য নাটকের মঞ্চ নির্দেশনা এবং কিছু ক্ষেত্রে সংগীত পরিচালনার কাজও করেছেন খালেদ চৌধুরি। তাঁর প্রতিটি কাজেই ছিল প্রতিভার স্বাক্ষর। তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর আঁকার ঝোঁক ছিল প্রবল। সেই সঙ্গে গানের প্রতিও ছিল তাঁর আকর্ষণ।মঞ্চ নির্দেশনার পাশাপাশি খালেদ চৌধুরি ছবি আঁকার কাজও চালিয়ে গেছেন। বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকিয়ে হিসেবে তিনি সত্যজিত্ রায়, মাখন দত্তগুপ্ত, সূর্য্য রায়দের সমগোত্রীয় হয়ে উঠেছিলেন।

প্রায় দেড় হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন খালেদ চৌধুরি। আর সংগীতের প্রতি প্রবল টানে তিনি মাঠঘাটে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন কয়েক হাজার লোকসংগীত।

Link copied!