মার্চ ৬, ২০২২, ১১:১৮ এএম
রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনের প্রতি জোরাল সমর্থন সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার আক্রমণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য পশ্চিমাদের যেসব পথ রয়েছে, সেগুলোও সম্ভবত সীমিত হয়ে আসছে। জি-৭ দেশগুলো গত শুক্রবার রাশিয়ার ওপর ‘নতুন কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ‘এরই মধ্যেই যে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে তা বাড়ানোর’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাশিয়াকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলার হুমকি ইউক্রেনে হামলা শুরুর অনেক আগে থেকেই দিয়ে আসছেন তারা। এখন আর তেমন কোনো কৌশল বাকি নেই। ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা দিয়েছিল, সেগুলো তারা রেখেছে। তারা রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থায় এবং ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে এবং আকাশসীমা ব্যবহারে রুশ বিমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পাশাপাশি বড় বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করেছে। বেশ কিছু পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। তা-ও কিন্তু ইউক্রেনে হামলা বন্ধ হয়নি।
ইউক্রেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম টেইলর বলেছেন, ‘অনেক লোকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, নিষেধাজ্ঞার হুমকি পুতিনকে থামানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কাজেই বাড়তি অবরোধে কাজে দেবে কি না, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। ’
এখন পর্যন্ত রাশিয়ার জ্বালানি খাত তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞা থেকে পার পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইনপ্রণেতা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার তেল আমদানি নিষিদ্ধ করার জন্য অনুরোধ করছেন, যা প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
কেউ কেউ রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে পশ্চিমারা জ্বালানি খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় এমন ব্যাংকগুলোকেই শুধু নিষেধাজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ হ্রাস পাবে এবং দাম বেড়ে যাবে। যার ভুক্তভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রাই।
কিয়েভ এবং অন্য শহরগুলোতে রাশিয়ার বিমান হামলা সীমিত করতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি ন্যাটোর প্রতি তাঁর দেশের ওপর একটি নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করার একমাত্র উপায় হলো ইউক্রেনের আকাশসীমায় ন্যাটোর যুদ্ধবিমান পাঠানো এবং তারপর সীমা না মানা রাশিয়ার বিমানগুলোকে গুলি করা। যদি আমরা তা করি, তবে ইউরোপে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বেঁধে যাবে। তাতে আরো অনেক দেশ জড়িয়ে পড়বে। এটি আরো অনেক বেশি মানবিক দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। ’
পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রা বর্তমানের নীতি থেকে বিচ্যুত হবে না, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত এই সংঘাত ইউক্রেন বা ন্যাটোভুক্ত নয়—এমন অন্য কোনো দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ওয়াশিংটন থেকে নির্বাচিত আইনপ্রণেতা অ্যাডাম কিনজিঙ্গার এবং রজার উইকারের মতো মুষ্টিমেয় কিছু রিপাবলিকান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শেষ পর্যন্ত নো-ফ্লাই জোনের ঝুঁকি নিতে হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে সে পথে হাঁটছে না পশ্চিমারা। তারা আপাতত ইউক্রেনের বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ক্ষেত্রেও পূর্ব ইউরোপে থাকা যুদ্ধবিমানসহ আরো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের দাবি উঠছে। ইউক্রেনের পাইলটরা ওই বিমানগুলো পরিচালনা করতে জানেন।
এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম পুতিনকে হত্যা করার জন্য ‘রাশিয়ার কাউকে’ এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি এর নিন্দা করে বলেছেন, ‘আমরা কোনো দেশের নেতাকে হত্যা বা ক্ষমতা পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলছি না। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিও নয়।’
তবে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, রাশিয়ার অর্থনীতি এবং সর্বোপরি দেশটির ধনকুবেরদের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যাঁরা ক্রেমলিনের কাছে থেকে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন তাঁদের কেউ কেউ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন।
ফ্রান্সের মিলিটারি একাডেমির ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের পরিচালক জঁ-বাপতিস্ত জাজাঁ ভিলমাখ বলেন, ‘একটি প্রাসাদ অভ্যুত্থান বা একটি অভিজাত বিদ্রোহের সম্ভাবনা যথেষ্ট। ’ তবে এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যান্ড করপোরেশনের স্যামুয়েল চ্যারাপ বলেন, ‘তাঁরা অত্যন্ত অনুগত। ’ তাঁর মতে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের পথ ধরে বাইডেনের উচিত নিষেধাজ্ঞার শক্তির ওপরই নির্ভর করে কূটনৈতিক চাপ দিয়ে রাশিয়াকে হামলা বন্ধ করতে রাজি করানোর চেষ্টা করা।
স্যামুয়েল বলেন, ‘এটা অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি এটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান, যা আমরা এখন করতে পারি। ’ আবার কেউ কেউ সমস্যার সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের অন্য প্রতিপক্ষ চীনকে ব্যবহারের পক্ষে। একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, এখন যা ঘটছে, তা বেইজিংয়ের জন্য ক্রমেই বেশি করে অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না দেশটি। চীন তাই পশ্চিমাদের চেয়ে পর্দার আড়ালে থেকে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।