যুদ্ধের প্রভাবে বাড়তি চাপে দেশের অর্থনীতি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২, ০৪:১০ এএম

যুদ্ধের প্রভাবে বাড়তি চাপে দেশের অর্থনীতি

রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি-এমন আশঙ্কা অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের। জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি সার ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।  

ইতোমধ্যে দাম বৃদ্ধি কৃষিজাত পণ্যের

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল। দেশে বছরে গমের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এ গম প্রক্রিয়াজাত করে ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বেড়েছে। গমের আটা ২ কেজি প্যাকেট আগে ছিলো ৭০ থেকে ৭৫ টাকা এখন ৮৫ টাকা। গম এখন কেজি প্রতি ৩৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে যা সপ্তাহখানেক আগে বিক্রি হতো ২৮ থেকে ৩০ টাকায়।

ভোজ্যতেলের জন্য সারাবিশ্বে সূর্যমুখী তেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশ্বে সূর্যমুখী তেল বা সানফ্লাওয়ার ওয়েল রপ্তানিতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইউক্রেন। বাংলাদেশে স্বল্প সানফ্লাওয়ার তেলের ভোক্তা হলেও পুরোটাই আমদানি নির্ভর। যার ফলে এই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। সানফ্লাওয়ার তেল কিংস ব্রান্ডের ৫ লিটার আগে ছিলো ১৩০০ টাকা হলেও বর্তমানে তা ১৬৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অলিটালিয়া ১ লিটার ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা গত মাসে ৩০০ টাকা লিটার প্রতিবিক্রি হয়েছে। এদিকে রূপচাঁদা ব্রান্ডের পাঁচ লিটার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও আগে ছিলো ৭৬০ টাকা।

ভূট্টা দেশি প্রতি কেজি ৪০ টাকা বিক্রি হলেও একসপ্তাহ আগে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ভূট্টা পপকন ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিলো ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।

শত কোটি ডলারের বেশি লেনদেন

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধরত দেশ রাশিয়ায় গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। একইভাবে ইউক্রেনে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি রয়েছে।

বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রপ্তানির পয়েন্ট থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। আমদানির ক্ষেত্রে তুলা, গমসহ কিছু পণ্য আনা হয়। এখন এসব পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।

রাশিয়ার সম্পদ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও পণ্য পরিবহণের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের বাণিজ্যে কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। কারণ নিউক্লিয়া সংক্রান্ত পণ্য রাশিয়া থেকে আনা হচ্ছে। পণ্য পরিবহণে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তবে যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের চাপের মধ্যে ফেলবে।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। তেলে মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সার ও গ্যাসের মূল্য বাড়বে। যুদ্ধের কারনে  রাশিয়ার ওপর দিয়ে জাহাজ ও বিমান চলতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের বিকল্প বাজার ও রাস্তা ব্যবহার করে পণ্য আনতে হবে। করোনার কারণে জাহাজ ভাড়া আড়াইগুণ বেড়েছিল। যুদ্ধের কারণে আরও বাড়বে। বাড়বে বিমান ভাড়াও।

রূপপূর চলমান থাকবে

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়গুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলেছে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চলবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন নির্মাণ করছে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এ প্রতিষ্ঠানটি পড়লে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার করা হয়নি।

তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি করোনাকালে বন্ধ হয়নি। এখনো বন্ধ হবে না।

বাড়তি ভর্তুকি সম্ভব নয়

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বাজেটে ৪৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ধরা হয়েছে। এটি এখন ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এটি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সার, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এগুলো আমদানি করতে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকির অঙ্ক। ক্রমেই চাপে পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতি।

উল্লেখ্য গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্ব যত গম রপ্তানি করে তার প্রায় ৩০ শতাংশ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টার প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চলতি মৌসুমে গম ও ভুট্টার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এসব পণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়বে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দামও বেশ চড়া।

Link copied!