বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির বর্বর হত্যাকাণ্ডে বিতর্কিত ভূমিকায় ছিল সিআইএ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১৫, ২০২২, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির বর্বর হত্যাকাণ্ডে বিতর্কিত ভূমিকায় ছিল সিআইএ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের ভূমিকা রয়েছে। আর জিয়াউর রহমান মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি—সিআইএ’র সমর্থন ছাড়া এক কদমও আগাতে পারতেন না। তাই শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান ও সিআইএ’ কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না।

২০২০ সালের ২১ আগস্ট ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার এক ব্যুরো রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওই বছরের ২০ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের গবেষণাধর্মী বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন(সিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ১৯৭৫: সেটিং দ্য ক্লক ব্যাক’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তাদের আলোচনাভিত্তিক ওই ব্যুরো রিপোর্টটি তৈরি করেন দীপঞ্জন রায় চৌধুরী।

ওয়েবিনারে বক্তব্য রাখেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং হংকংভিত্তিক ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক সংবাদদাতা লরেন্স লিফশুলজ, ইতিহাসবিদ ও নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার সলিল ত্রিপাঠী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নাসরিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাংবাদিক ও জীবনীকার সৈয়দ বদরুল আহসান এবং কলামিস্ট ও ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক  জাফর সোবহান।

ওয়েবিনারে উঠে আসে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট  বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের ভূমিকা পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত করা হয়নি। পাশাপাশি ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানসহ আরও কয়েকজন ‘অভিনেতা’র কর্মকাণ্ড নিয়েও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হয়নি।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি হওয়া জেনারেল জিয়াউর রহমান একজন ‘সাইকোপ্যাথ’ ছিলেন। অন্যদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়াও তাঁর উদ্দেশ্য পূরণে তিনি সহিসংতাকে বেছে নিতেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ওই ওয়েবিনারে অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং হংকংভিত্তিক ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক সংবাদদাতা লরেন্স লিফশুলজ (ইংরেজি: Lawrence Lifschultz) হত্যাকাণ্ডের পুরো পর্বটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করার পরামর্শ দেন।

হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা জড়িত ছিলেন তারা কেউ জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছাড়া এক পা-ও চলতে পারতেন না বলেও দাবি করেন তিনি। আর মার্কিন সমর্থন ছাড়া জিয়া চলতে পারতেন না।  ‘আমার দৃষ্টিতে এটির আরও তদন্ত হওয়া দরকার।’

লিফশুলজ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার প্রশংসা করেন এবং বলেন  সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি খুবই দরকার ছিল। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল বিরল এবং কৌশলগত চক্রান্তের ফসল।

ওয়েবিনারে লিফশুলজ বলেন, “অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জিয়া। আমরা আরও জানি ঢাকায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ স্টেশন প্রধানের সাথে জিয়া একটি ব্যক্তিগত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আমরা এ-ও জানি, ওই সময়ে মার্কিন দূতাবাসে  প্রচণ্ড উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কারণ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার নির্দেশ দিয়েছিলেন অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারী বা চিন্তাধারী কোনো ব্যক্তির সাথে মার্কিন দূতাবাসের সদস্যরা যেনো কোনো ধরণের যোগাযোগ না রাখে। আর এটা নিয়েই দূতাবাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল।”

লিফশুলজ বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহের সময় জিয়া পাকিস্তানসহ অন্যদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। আমরা একটি সত্যিকারের সামরিক স্বৈরতন্ত্র দেখলাম যে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ভয়ানক ছিল।”

১৯৮৬ সালে তরুণ সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃতি খুনি কর্নেল ফারুকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সলিল ত্রিপাঠী।

সলিল ত্রিপাঠী বলেন, “সবেমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্নাতক পড়াশোনা শেষ করে আমি ভারতে ফিরে আসি। পরে বাংলাদেশে আসি মূলত  ১৯৭৫ সালে কী ঘটেছিল, এমন কি ভুল ছিল— এসব ছিল আমার প্রশ্ন। আমার প্রশ্ন ছিল, কেন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদারনীতির গতিপথে চলা একটি দেশের অবসান ঘটলো? শুধুমাত্র একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জেলহত্যা, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে? 

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “ঢাকায় এসে তিনি এমন কিছু খুঁজে পান যা কিনা ‘একজন ফিকশন লেখকই’ শুধু কল্পনা করতে পারেন। যে লোকটি (কর্নেল ফারুক) ছিলেন একজন আত্মস্বীকৃতি খুনী, তিনিই কিনা ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা স্বীকার করার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন!”

ত্রিপাঠী আরও বলেন, “তাই ওই লোকটির (কর্নেল ফারুক) ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে ঢাকায় থাকার সময় আমি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমার সাথে দেখা করতে খুব সহজেই রাজি হয়ে যান। আমার মনে আছে, ঢাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পাহারায় ঘেরা সুসজ্জিত একটি বাড়িতে আমি তাঁর সাথে দেখা করি। ওই সময় তিনি পাঠানদের পোশাক পরিহিত ছিলেন। ওই পোশাক ঐতিহ্যগতভাবে পূর্ব বাংলার লোকদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে আদৌ পরিচিত নয়-এটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আমাকে তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি লিবিয়ায় ছিলেন। তিনি প্রচণ্ডভাবে আত্মবিশ্বাসীও ছিলেন।”

সূত্র: ২০২০ সালের ২১ আগস্ট ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত ‘CIA's alleged role in gruesome assassination of Bangladesh's 1st President’ প্রতিবেদনটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মিজানুর রহমান খান।

Link copied!