‘আমরা নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। সময়মতো অফিসে যেতে না পারলে অসুবিধায় পড়তে হবে। মাস শেষে বেতন থেকে টাকা কাইটা রাখবো। গতকালও অনেক কষ্টে বেশি ভাড়া দিয়ে অফিসে পৌঁছেছি এবং অফিস থেকে আবার বাড়ি এসেছি। ভেবেছিলাম ধর্মঘট ছেড়ে দেবে। কিন্তু আজও দেখছি একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সড়কে কোনো গাড়ি নেই। এমন হলে আমাদের মতো গরিব মানুষের বেঁচে থাকার উপায় নেই।’
কারওয়ানবাজার মোড় থেকে মতিঝিল যাওয়ার জন্য রিকশা ভাড়া ঠিক করছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী নাইমুল ইসলাম। চোখে মুখে ক্ষোভ নিয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে এসব বলেন তিনি।
রবিবার (৭ নভেম্বর) সকাল থেকে সরেজমিনে রাজধানীর রামপুরা, বাংলামোটর, পান্থপথ ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে অফিসগামীদের ভোগান্তির চিত্র দেখা যায়।
রামপুরা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ইমরান একজন ব্যবসায়ী। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে কথা চলাকালীন সময়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই মাসে যা আয় করার সম্ভাবনা ছিলো সেটা শেষ। টানা তিনদিন যে ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করছি তা আমার প্রায় অর্ধেক মাসের যাতায়াত ভাড়ার সমান।
কথা হয় নাজমুল নামে এক সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকের সঙ্গে। বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তিনি বলেন, এখন এইগিনাও আমাগো আয় রুজগার। হগগোল ডেরাইভাররা যা ভাড়া নেয়, আমিও তাই নেই। এই সময় একটু বাড়তি আয় করার সুযোগ পাইছি। তাই করতেছি। যার যাইতি মন চায় যাবি, না যাইতি মন না চাইলি যাবিনা’।
ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে থাকা সুফিয়ার সাথে কথা হয়। তিনি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তিনি জানান, গত দুইদিন অফিস ছিলো না। কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতিতে আমি বুঝেই বের হইছিলাম যে আমি ট্রান্সপোর্ট ভোগান্তিতে পড়বো। কিন্তু এতটা ঝামেলায় পরবো তা বুঝিনি। বাসা থেকে বের হয়েছি ৭টায়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ভাড়ায় চলা মোটরসাইকেল যে ভাড়া চাইলো সেটা দিয়ে একদিন অফিস গেলে বাকি ১৫ দিন কিভাবে যাবো সেটা বুঝতেছিনা। আবার এদিকে এক-দুই ঘণ্টা পর একটি বিআরটিসি বাস আসার সাথে সাথে ফুল হয়ে যাচ্ছে। উটতে পারছিনা বাস এ। কেউ সিরিয়াল মানছে না।
বাংলামোটর দাঁড়িয়ে থাকা রাইড শেয়ারিং পাঠাও এক চালকের সাথে আলাপচারিতাকালে তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ভাড়া একটু বেশি। কারণ বাস চলছে না, এখন প্রাইভেট যানবাহনই ভরসা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কথা হয় নিহাল নামে এক তরুণের সঙ্গে। ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কোনো বাস পাচ্ছেন না। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চাচ্ছে তিনগুণ ভাড়া। পকেটে এত টাকাও নেই। হেঁটেই যেতে হবে গন্তব্যে।
পাঠাও চালক তৈয়ব রহমান জানালেন, তিনি মিরপুরের ইসিবি চত্বর থেকে শান্তিনগরে নিয়ে গেছেন এক চাকরিজীবীকে। যাত্রার শুরুতে অ্যাপে তার ভাড়া দেখানো হয় ১৯৮ টাকা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে সেই ভাড়া হয়ে যায় ২৯৮ টাকা। ফলে এ নিয়ে বাধে বাগ্বিতণ্ডা। যানবাহনের চাহিদা ও চাপ বিবেচনায় পাঠাও কর্তৃপক্ষ এলাকাভিত্তিক ভাড়া বাড়িয়েছে বুস্ট করার কায়দায়।
তিনি নিজের মোবাইল ফোনের অ্যাপ থেকে দেখান, গতকাল প্রায় পুরো ঢাকা শহরেই ৫০ শতাংশের বেশি পর্যন্ত ভাড়া বুস্ট করা ছিল।
ফার্মগেট মোড় ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে যানবাহনের আশায় বহু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে বিআরটিসির দু-একটি বাসের দেখা মিললেও তাতে পা রাখার জায়গা ছিল না। এর মধ্যেই যারা ঠাসাঠাসি করে গেছেন, তাদের ভাড়া নেওয়া হয় দ্বিগুণ। ফার্মগেট থেকে গাবতলীর ভাড়া ১৫ টাকা হলেও গতকাল নেওয়া হয় ৩০ টাকা।
শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই ধর্মঘটে বাস না পেয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীসাধারণ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি দুই বছর আগে দূরপাল্লা ও নগর পরিবহনে যে ভাড়া প্রস্তাব করেছিল, বাস মালিকরা এখন তার চেয়েও বেশি চাইছেন। তাদের দাবি পূরণ হলে বাস ভাড়া বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
বিআরটিএর কমিটি ২০১৯ সালে দূরপাল্লা বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে দুই টাকা সাত পয়সার প্রস্তাব করেছিল। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগর পরিবহনে ভাড়া প্রস্তাব করেছিল কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা বাড়িয়ে দুই টাকা ২১ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে মালিকরা এ প্রস্তাবের চেয়েও বেশি চাইছেন।
ডিজেলের বর্ধিত মূল্যের সঙ্গে ভাড়া সমন্বয় করতে আজ রবিবার ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটির সভা হবে। বাস মালিকদের যুক্তি, শুধু ডিজেলের দাম নয়, গত দুই বছরে বাসের সব ধরনের যন্ত্রাংশের মূল্য, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, বেতন ভাতা ও মুদ্রাস্ম্ফীতি বেড়েছে। তাই ভাড়া ২০১৯ সালের প্রস্তাবের চেয়ে বেশি বাড়াতে হবে। তবে কত করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মালিকরা তৈরি করেননি। তারা ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরবেন আজকের সভায়।
এদিকে, শুক্রবারের মতো গতকাল শনিবারও বিআরটিসি ছাড়া সারাদেশে কোনো বাস চলেনি। মালিকদের ভাষ্য, লোকসান এড়াতে বাস বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮০ টাকা করা হয়। এরপর শুক্রবার সকাল থেকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরিচালক-মালিকেরা গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বাস-লঞ্চ মালিকেরাও।